একজন মা

নূরুল ইসলাম লাবলু

…………………………….

একজন মা-১

দেখুন প্রথমেই একটা কথা বলে রাখি আমি গৃহিনী, গল্প লেখক না। আমার লেখার মধ্যে ত্রুটি থাকবে অসংখ্য। বাক্য সম্পূর্ণ নাও হতে পারে, অনেক সময় বানান ভুল থাকতে পারে। আপনাদেরকে সেসব বুঝে বুঝে পড়তে হবে। আমি জাস্ট একটা কাহিনী বলবো, যা আমার নিজের জীবনে ঘটে গেছে। মা তো আমি। আমার দুটি মেয়ে, এই গল্প বড় মেয়েটির। ভাবলাম, আমার মত আরো তো অনেক মা আছেন। তাদের যদি আমার এই গল্প কোন কাজে লাগে, লাগবেই তা না। তবে মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গল্প অনেক সময় অন্যের জন্য দরকারি হতে পারে।

আম খুলনা কমার্স কলেজ থেকে এম এ পাশ করেছি। দেখুন, আমার জীবনে কোন থার্ডক্লাশ ছিল না। কিন্তু বিয়ের পর শশুর বাড়ি এসে স্বামী, সংসার, বাচ্চা, ইত্যাদি সামলে আমি ঠিক মত পড়াশুনা করতে পারিনি। আমার স্বামী আমাকে জোরাজুরি করে ইমপ্রুভমেন্ট দিতে বাধ্য করেছিল, কিন্তু ঐ পর্যন্ত। যদি সত্যি বলি, আমি তার দিক থেকে কার্যকর কোন সহযোগীতা পাইনি। সে বলার সময় খুব বড় করে বলে, কিন্তু কাজের বেলায় অনেক সময় পেরে ওঠে না। লজ্জিত হয়। কিন্তু লজ্জিত হয়ে লাভ কি? প্রতিশ্রুতি দেবার বেলায় প্রত্যেকের সচেতন থাকা উচিত, বিশেষত: দাম্পত্য জীবনে।

স্ত্রী হিসেবে তার বিরুদ্ধে আমার অনেক অভিযোগ আছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে তার সাথে এক ছাদের নিচে জীবন পার করার বেলায় খুব বেশী খারাপ লাগছে না। একটু আদ্দেক ঠোকাঠুকি সব সংসারেই হয়। যাহোক, মোটের ওপর মানুষটা সে খারাপ না। আমিও শতভাগ সুখি নই, আর দশজনের মত। কিন্তু অনেকের মত আমিও সন্তষ্ট থাকার সংগ্রামে থাকি। মাঝে মধ্যে ভান করি ভাল থাকার। হাসি মুখে বলি, ভাল আছি।

আমার মেয়েকে নিয়ে আমি ভাল নেই, কিন্তু আমি হাসি মুখে বলি, ভাল আছি। সেই গল্পই আমি আপনাদের বলবো।

একজন মা-২

আমি শারিরিক সৌন্দর্যের আঁধার না। কিন্তু ছেলেদের একধরণের আকর্ষণ আমার উপর আমি সবসময় উপলব্ধি করেছি। এটা করা যায়। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি কখনো সাধারণ বন্ধুত্ব বা ক্লাশ সম্পর্কের বাইরে কারো প্রতি আমি দুর্বলতা অনুভব করিনি। তাছাড়া, কি কারণ কে জানে, প্রিম্যারিটাল অ্যাফেয়ার, দাম্পত্য সম্পর্ক, বিয়ে, স্বামী, সংসার, এই সব নিয়ে বন্ধুদের সাথে জমানো কোন আড্ডায় আমি কখনো বড়ভাবে পার্টিসিপেট করিনি। কিন্তু তাই বলে মা-খালাদের আলাপ, বয়স্ক মানুষের সমালোচনা- এসব থেকে সিম্পল মেয়েলি ব্যাপারস্যাপার সম্পর্কে আমার যে কোন ধারণা জন্মেনি- তাও নয়।

আমি বলি কম, শিখি প্রচুর। প্রায়শঃই দেখা যায়, আমি দেখে ও শুনে শিখছি।  ঠেকে কম। আমাকে কেউ যদি একবার দেখিয়ে দেয় কিভাবে কি করতে হয়, আমি পেরে যাই। কোন প্রবলেম সলভ করার জন্য আমাকে শুধু কায়দাটা দেখিয়ে দিলেই হয়, আমি সমাধান করে ফেলি। এবং তা প্রশংসনীয়ভাবে। সামাজিকতা, দায়িত্ববোধ, কর্তব্য, পারিবারিক ইনভলবমেন্ট এসব নিয়ে আমাকে কারো কখনো গাইড করা লাগেনি। আমি ইনবর্নলি শিখেছি। করেছি। এবং অমার যথেষ্ট সুনাম আছে। অথচ দেখুন, সেই মানুষ আমি, বিয়ের পর কেমন যেন লাউগাছের মত হয়ে গেলাম। মাচাং ছাড়া আমি আর বাড়তে পারলাম না। না আমি আর অভিযোগ করবো না। শুধু একটা ঘটনা বলি।

বাপের বাড়ি থেকে ফিরছি। বাসে আমরা দুজন। সামনে সিট পাইনি। তার আবার সামনে বসাতে আপত্তি। সেও এক হাস্যকর ব্যাপার। আপত্তি ভয়ের কারণে। বাসস্টান্ডে একসময় চাকরি করতো। বলে, দেখো টুম্পা, আমি দীর্ঘদিন বাসস্টান্ডের মটর শ্রমিক ইউনিয়নে চাকরি করেছি। কোন শ্রমিক কে দেখিনি কখনো বাসের প্রথম দিকে ফ্রি সিট নিতে। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম ভাই আপনারা সবাই পিছনে বসে যাতায়াত করেন। সামনে বসে যান না। কেন? বলল, একসিডেন্টের কারণে। দেখবেন বাস একসিডেন্ট করলে মানুষ যারা মারা যায় তারা সবাই সামনের যাত্রি। সামনে এবং ডানপাশের।

আমি তাকে বললাম, আরে বাবা। মালিকপক্ষের তরফ থেকে শ্রমিকপক্ষের জন্য ওটা একটা ভুগোল। সামনের সিটের জন্য তারা যেন কাড়াকাড়ি না করেন। কারণ সেগুলি বিক্রির বাজারে আকর্ষণীয়। “ভাল কথা বলেছোতো টুম্পা, এভাবে তো ভেবে দেখিনি।” একথা বললেও, তাকে কোন আমি সামনে বসাতে পারিনা। সে বাসের ডান দিকে বসে যেতেও নারাজ। ওয়েল, আমরা পিছনে বসে যাচ্ছি। যে কোন ঝাকি পিছনে একটু মর্মান্তিকভাবে লাগে জানেনতো। আমি একটা ঝাকি খেয়ে ককিয়ে উঠলাম- “ও মা”।

রবি আমার পাশে। বলল, কি ব্যাপার কি হলো তোমার? চিৎকার করে উঠলে যে!

ব্যথা লাগলো

কোথায়?

আমি আমার পেটের দিকে নির্দেশ করে বললাম- “এই খান টাতে”।

সে আমার দিকে তাকালো। “তারমানে?”

“আমিতো তোমাকে কন্ট্রাসেপটিভ য়্যুজ করার কথা বলেছিলাম। তুমি শোননি। সামনে আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা। যদি কনসিভ করে থাকি তাহলে পরীক্ষার সময় ওম্ব হবে বিশাল। অতবড় পেট নিয়ে পরীক্ষা?.. তোমাকে আগে ভাগে জানিয়ে রাখছি, আমি কিন্তু তা পারবো না”

বেচারা হা হয়ে গেল।

সরল সোজা মানুষতো। কথায় কথায় হা হওয়াটা তার স্বভাব।

একজন মা- ৩

বাড়িতে ফিরে আসার পর, যা সাধারণত হয়ে থাকে মেয়েদের, বমিবমি ভাব, মাথা ঘুরানো। ডেট পার হয়ে যাচ্ছে, নো ব্লিডিং। ভাবসাবতো গোপন থাকার নয়। গা জ্বলে যেতে লাগলো শাশুড়ির আমার দিকে তাকানো দেখে। রাগতো ঝাড়তে পারছি না। রাগ গিয়ে পড়লো নিরিহ মানুষটার ওপর। “আমি কিন্তু তোমাকে বলেছি যে নো বাচ্চা এখন, রাইট?”

“আচ্ছা দেখছি।”

“দেখছি না। আজই তুমি কথা বলবে তোমার জুট মিলের ডাক্তারের সাথে।”

“বলবো।”

সেদিন বাড়ি ফিরে এসে আমার পিছনে ঘুরঘুর করতে শুরু করলো রবি। গ্রাম থেকে একজন অতিথি এসেছেন। শুধু মাত্র রাত্রিটুকু থাকবেন। তার জন্য বিকেলে ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে রান্না করছি। রান্নাঘরে হাজির।

“আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি।”

“কি বললো ডাক্তার?”

“ডাক্তার তো একগাদা কমপ্লিকেশনসের কথা বললেন।”

“কি কমপ্লিকেশনস?”

“বললেন যে, অনেক সমস্যা হবে–”

“সেই সমস্যা গুলি কি? ভুমিকা করছো কেন?”

“ডাক্তার বললেন যে ফাস্ট ইস্যু অ্যাবরশনে সিভিয়ার ব্লিডিং থেকে শুরু করে সেকেন্ড ইস্যুর মিসকারেজ, ক্রনিক মিসকারেজ, ইউটেরাসের বাইরে ফুল বেরিয়ে আসা, বন্ধাত্ব, নানারকম সমস্যায় ভোগে মেয়েরা।আর–” আগুনের মত চোখ করে আমি বললাম, “আর তারপর বললেন যে, আমি যেন অ্যাবরশনের কথা না ভাবি তাইতো? পারলে বাচ্চাটাকে যেন আমরা রেখে দেই। তাইনা?”

“আশ্চর্য তুমি এরকম করছো কেন?”

“আমি জানতাম তুমি এরকমই কিছু বলবে”

“জানতেই যখন তখন পাঠালে কেন?”

“পাঠিয়েছি দিন তারিখ ঠিক করতে, কবে কখন তার কাছে যাবো। সেজন্য”

“উনি এসব করেন না।”

“তাহলে তো আড়াইশো বেডের আউটডোরে ঢুকতে যে এমআর ক্লিনিকটা আছে সেখানে যেতে হবে।”

রবির মাথাতেই ছিল না আমি এতদুর অব্দি চলে যেতে পারি। আড়ালে অাড়ালে এত খোঁজখবর করতে পারি। তার বিস্ময়ের ঘোরের মধ্যেই আমি তাকে বললাম, “শোনো, কোন দ্বিধা নেই। ডিসিশান ফাইনাল। তোমার মা যেন নাটক না করে।”

“কেউই কোন নাটক করবে না”

সত্যিই তাই। কেউই কোন নাটক করেনি। আমরা রিকশা করে ক্লিনিক পর্যন্ত যাচ্ছি। যেন সিম্পল কোন কেনাকাটা আছে আমাদের।

রবি আমাকে কিছু বলছিলো না। পথে যেতে যেতে। কিন্তু কেমন যেন করছিল ও। আমার ছোটভাইয়ের একঝাঁক কবুতর ছিল, মনে আছে। ডিমপাড়ার আগে মা কবুতরটার প্রতি পুরুষ কবুতরটার অসম্ভব টান তৈরী হতো। ওর কান্ড দেখে সেই পুরুষ কবুতর গুলির কথা মনে পড়লো। হঠাৎ কোথায় যেন একটা সুক্ষ্ণ মায়া অনুভব করলাম। আমি মত পাল্টালাম। সোনাডাঙ্গা বাসস্টান্ডের কাছ থেকে রিকসাওয়ালাকে শিববাড়ির মোড় নির্দেশ করে বললাম, ভাই ঐ দিকে যান।

একদিন মেয়ে জন্ম নিলো, মেয়ের নাম রাখলাম মালিহা। এই মেয়ের গল্পই বলছি। সমস্যা হলো মেয়ের গল্প আর মায়ের গল্প আলাদা করতে পারছি না। পারা যায়?

একজন মা- ৪

মেয়েদের পত্রিকা হিসেবে আমার দৌড় সানন্দা পর্যন্ত। বিয়ের আগে অনিয়মিত পড়তাম। কারণ কেনা হতো না আমাদের বাড়িতে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে এই একটা পত্রিকা আমি নিয়মিত পড়তে শুরু করি। আমার আগ্রহ নিবদ্ধ থাকে চাইল্ড রিয়ারিং, টিনএজ ক্রাইসিস, ইত্যাদির মধ্যে। আমার ছোটমেয়েটি তখন জন্ম নিয়েছে। ২০০৮ সালের দিকে। দুপুর বেলা মেয়েটাকে ঘুম পাড়িয়ে পত্রিকা নিয়ে বসেছি। পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে একটি প্রতিবেদনের দিকে নজর গেল। পশ্চিমবঙ্গের এক ডাক্তার একটি জার্নাল আর্টিকেলের রেফারেন্সে বলছেন Teen Girls Have Tougher Time Than Boys মালিহার তখন সমাপনি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়। এর মধ্যে ওর পিরিয়ড শুরু হয়েছে। রচনাটি আমি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়লাম। বয়:সন্ধিকালে টিনেএজ ছেলেদের থেকে মেয়েদের স্ট্রেসটা একটু বেশী থাকে, কিন্তু প্রতিবেদনের কোথাও এটা লেখা নেই কেন।

কোন বিষয়ে আমার কৌতুহল হলে সহজে মাথা থেকে যায় না। সন্ধার পর রবি অফিস থেকে ফিরে এলে আমি তাকে বললাম, চলতো একটু বাজারে যাই।

কেন?

মেয়ের জন্য প্যাড আনতে হবে।

নিরালার মোড় থেকে আনলেই তো হচেছ।

শুধু প্যাড নয়, অন্য কাজও আছে।

সেটা বল। কিন্তু আজ না গেলে হয় না? টায়ার্ড লাগছে

কোন দিন টায়ার্ড লাগে না তোমার

বিশ্বাস কর শরীরটা ভেঙেচুরে পড়ছে। কাল যাই চল। কাল গেলে হয় না?

না হয় না।

বাজারে গিয়ে সোজা বইয়ের দোকানে। বললাম, ভাই চাইল্ড ডেভলপমেন্টের ওপর কি বই আছে আছে আপনাদের?

দোকানদার আমাকে সম্ভবত: কলেজিয়েটের কোন ছাত্রী মনে করেছেন। তিনি বললেন, আপা আমারা কোন অ্যাকাডেমিক বই বিক্রি করি না। আপনি যে বই খুঁজছেন তা সম্ভবত: সোহাগ বুক ডিপো ছাড়া পাবেন না।

সোহাগ বুক ডিপোতে কিছু রেফারেন্স বই পাওয়া গেল যার সবগুলিই ইংরেজীতে লেখা। বইগুলি চুড়ান্ত অ্যাকাডেমিক বই। আমি খুঁজছি পপুলার ধর্মী লেখা।  এবং বাংলায়। কারণ আমি তো ইংরেজীতে বকলম।

আসার পথে রবি জিজ্ঞাসা করলো, ভাল করে বলতো তুমি আসলে কি খুজছো?

আমি বললাম, খুজছি টিন এজ মেয়েদের সম্পর্কে কোন বই।

ও বলল, ঠিক একজাক্ট কোশ্চেনটা বল। আমি বললাম, Teen Girls Have Tougher Time Than Boys, মাই কোশ্চেন ইজ হোয়াই?

একজন মা- ৫

রবি বলল, আলতুফালুত বিষয়ে এত কৌতুহল কেন তোমার? আমাদের এক স্যার বলতেন ‘কৌতুহল সর্বনাশকে পথ দেখিয়ে আনে’। কোন কাজ তো নেই সারাদিন। ফলে দিনভর শুধু সানন্দা আর সানন্দা।

কোন কাজ নেই মানে?

কি কাজ কর তুমি?

মানে?

ভাত রান্না, বাচ্চা পালন, ঘুম। আর পড়ে পড়ে পত্রিকার পাতায় মুখ। ওসব ছাতামাথা মুখস্থ করে কি হবে বলতো?

বুঝতে পারছেনতো? এই হলো রবিউল ইসলাম। রবি। এই লোকের সংসার আমি করি। তার কাছে ঘরের কাজ কোন কাজ নয়। তার বক্তব্য হলো লেখাপড়া শিখলেই তাকে চাকরি করতে হবে। টিপিক্যাল চিন্তাভাবনা। অ্যাকাডেমিক পড়াশুনার বাইরে মানুষের জ্ঞানের পরিধি প্রশস্ত না হলেই মানুষ এভাবে ভাবতে আর বলতে শুরু করে। কিন্তু যাদের উপলব্ধির যোগ্যতা আছে তারাই এই সন্তান প্রতিপালনের কাজটাকে সবথেকে বেশী শ্রদ্ধা করে। যাহোক, আমাদের কথাবাত্রার ধরণ ও তর্কের বিষয়বস্তু শুনে কিনা কে জানে, রিক্সাওয়ালা বার বার পেছন ফিরে আমাদের দেখছিলেন। তখন রাগ হলো। কিন্তু মাথার আগুন মাথায় রেখে, আস্তে করে রিকশা ওয়ালা কে বললাম,ভাই আপনি দেখে শুনে চালান। সমস্যা হতে পারে। আর রবিকে বললাম, মুখস্ত করেই অনেক কিছু হবে।

তারপর একটু ঠেস দিয়ে বললাম, কি হবে না হবে তুমি তার কি বুঝবে? আল্লাহ তোমাকে সেই জ্ঞান দেয়নি।

রবি বলল, ঘোড়ার ডিম হবে। বাস্তব জীবনে যখন সমস্যায় পড়বে তখন দেখবে অর্জিত জ্ঞান কোন কাজে লাগছে ন। বইয়ের পাতার সাথে বাস্তবের কোন কিছু মিলছে না। যাওয়া লাগছে বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ নিতে। বড় মেয়েকে নিয়ে কনস্টিপেসনের কথা মনে নেই? প্রথমে শিশু হাসপাতালের সমস্ত ডাক্তার চষে ফেললে। তারপর গেলে ঢাকা। সেখানে ফজলুর রহমান থেকে শুরু করে, নাজমুল আহসান, পরিতোষ। কত ডাক্তার কবিরাজ। শেষ পর্যন্ত গেল কিসে? হোমিওপ্যাথির ফোটায়।  পরিকল্পনা করে বা পড়ে কোন কিছু হয় না টুম্পা। “ভাগ্যে যদি থাকে শনি/যায়না কিছুতে তা জানি।”

মুর্খ মানুষের মত কথা বলবে না, প্লিজ।

আমি মুর্খ মানুষ?

মুর্খ ছাড়া কি? অফিস থেকে বাড়ি ফিরে পত্রিকার হেডলাইন আর টিভি। আর কি কর তুমি? কোনদিন কোন প্রবন্ধ, গল্প, এসব পড়েছো? একটা আগাগোড়া উপন্যাস পড়েছো জীবনে? একাডেমিক প্রয়োজন ছাড়া কোন কবিতা? জীবন সম্পর্কে তোমার ধারণা তো জুটমিলের লে অফ, ক্যাশ পেমেন্ট আর লেজার বুক পর্যন্ত। আর একটু যদি বেশী হয় তাহলে বাল্ক কারগো, কনটেইনার টার্মিনাল, চার্টার রেট ইত্যাদি। ..খোদা, কার সংসার যে করি।

গল্পের বই তুমি কখনো পড়?

গল্পের বই না পড়লেও ননফিকশন তো পড়ি।

পড়। পড়ে দুনিয়া উদ্ধার কর।

আমরা ঝগড়া করতে করতেই বাড়িতে এলাম। কিন্তু ভবিতব্য কি একেই বলে? কে জানতো মেয়েকে নিয়ে আমি পড়বো এমন অবস্থায়, যেখানে রবির কথামত, পুরনো জ্ঞান হয়ে যাবে অচল?

ভালই ছিলাম আমরা। রবি অফিস থেকে বাসায় ফিরে ঘরকুনো মানুষের মত ঘরেই থাকতো। আড্ডা বন্ধুবান্ধব কিচ্ছু না। কোন নেশা নেই। যদিও তার সাথে একটা কালচারাল গ্যাপ আছে আমার, আপনারা বুঝে থাকবেন। কিন্তু একজন ইনফর্মড মানুষ কি করবেন? আমি আমার রেন্সপন্সিবিলিটি দিয়ে সবকিছুকে ওভারকাম করে গেছি। সে আমার কোন কাজে সাহায্য না করলেও, অনেস্টলি, আমাকে ডিস্টার্ব কখনো করতো না। আইমিন, এমন কোন পরিস্থিতি তৈরী করতো না যাতে আমার অস্বস্তি হয়। আমি বাচ্চাদের নিয়ে ঘরের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম। ভালই সময় যাচ্ছিলো আমার। শুধু একটা রাত আমি বাইরে ছিলাম। একটা রাতেই ঘটে গেল ঘটনা। আমাদের জীবনটা তছনছ হয়ে গেল।

আমার ছোটমেয়ে মণিষা অসুস্থ্য হলে ওকে নিয়ে হাসপাতালে গেছি। ডাক্তার বললেন, থাকতে হবে। আমরা থেকে গেলাম।

এই রাতে মালিহা ছিল আমার বোনের কাছে।

একজন মা- ৬

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া দারুণ ঝামেলার কাজ। এক ডাক্তার বলে গেলেন, আমরা যেতে পারবো। আর এক ডাক্তার এসে বললেন, তার মত নেই। আমাদের যদি যেতেই হয় দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। দুপুরে আগের ডাক্তারের রাউন্ড। তখন তার দেখা মিলবে। তিনি আসলে আমরা যেন তার মাধ্যমে ছুটি করি।

দুপুর আর হয় না। ছাড়া পেতে পেতে শেষ বিকেল হয়ে গেল।

বড় মেয়েটাকে নিয়ে নিউমোনিয়ার ঝামেলা পোহানোর পর মণিষাকে নিয়ে আমি খুব সতর্ক থাকি। কিন্তু তাকে নিয়েও এই দু’দুবার হাসপাতালে থাকা হয়ে গেল। বাচ্চাদের আন্ডারওয়েট ভারি বাজে ব্যাপার। বয়স তুলনায় ওজন কম হলে সারাক্ষণ এটাসেটা লেগেই থাকে। খাওয়ানোর জন্য ওজন বাড়ানোর জন্য কত কিছু করি। তারপরও শতভাগ সাকসেফুল হতে পারি না। অনেককেই দেখি আমার মত খাওয়ানো নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন। ফলে বিষয়টা গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। আমার মেয়েকে খাওয়ানো মানে দুই ঘন্টার যুদ্ধ। মা তো, করে যাচ্ছি।

বাড়িতে ফিরে দেখি মালিহা ঘুমুচ্ছে। মাগরিবের আযানের সময় তখন। আমি অবাক। এরকম সময় ঘুমুচ্ছে মানে?

আমাদের বাসার ছোটখাটো কাজে সহায়তা করে যে ভদ্রমহিলা, তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “রতনের মা, ও ঘুমিয়েছে কখন?”

রতনের মা বলল, “দুপুরের আগে।”

আমি যখন মোবাইলে কথা বলি তখন সাড়ে এগারোটার মত বাজে। ঘন ঘন হাই তুলছিল মেয়ে।  আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কি মা, শরীর ক্লান্ত লাগছে?”

মালিহা বলেছিল, “না এমনি। ক্লান্ত লাগবে কেন? ঠিক আছে।” রাত না জাগলে এরকম ক্লান্ততো হওয়ার কথা নয়। আমি মণিষার প্রেসক্রিপশনটা একবার পড়লাম। এজিথ্রোমাইসিন গ্রুপের একটা সাসপেনশন, একটা জিংক ও একটা কাশির নর্মাল সিরাপ। সাসপেনশনটা দিনে একবার। বাকিটা দুবার করে। অসুধপত্র ব্যবহারের বেলা আমি খুব সাবধানি। এ ব্যাপারে আমি ওদের বাবার ওপরও নির্ভর করি না। রবি একদিন এক্সপায়ারড ডেটেড অসুধ কিনে এনেছে। আর একবার ভুল পড়েছে অসুধের ডোজ।

সাসপেনশনটা বানানোর জন্য চুলায় গরম পানি চাপিয়ে এসে মেয়েকে ডাকলাম, “মালিহা, মা তুমি এই অবেলায় ঘুমাচ্ছো কেন?”

মেয়ে পাশ ফিরে শুয়ে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো।

আমি বললাম, ‘একটু পর আযান হবে, ওঠো।”

মালিহা ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “আমি রাতে ঘুমাই নি। এখন ঘুমাবো।”

“রাতে ঘুমাওনি মানে?”

মেয়েকে একথা জিজ্ঞাসা করতেই মেয়ের ঘুম ছুটে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল, “না মানে ঐ। ঘুমের ঘরে তোমাকে কি বলতে কি বলে ফেলেছি। ঘুমাবো না কেন? কিন্তু এমন ঘুম পাচ্ছে এখন”

“আম্মু তুমি কি কিছু গোপন করছো আমার কাছে?”

“না না গোপন করবো কেন?”

“তুমি গোপন করছো। একটা কিছু লুকচ্ছো আমার কাছে। কি হয়েছে আমাকে বলতো। সোনা মা আমার।”

“কিছু হয়নি মা। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো। আমার জাস্ট একটু ঘুম পেয়েছিল। তাই ভাবলাম ঘুম দেই। আর কিছু না।”

আমি উঠে চুলোর কাছে গেলাম। সাসপেনশনের ফুটন্ত পানিকে নামিয়ে ঠান্ডা পানির একটা পাত্রের ভেতরে রাখলাম যাতে একটু দ্রুত ঠান্ডা হয়ে যায়। ওর বাবাকে বললাম, একটা কিছু গোলমাল হয়েছে।

ওর বাবা বলল, কি গোলমাল?

“মেয়েটা কি যেন লুকোচ্ছে আমার কাছে”

“কি?

“কি সেটাই তো বুঝতে চাইছি।”

“কি দেখে মনে হলো সে লুকচ্ছে?”

“তুমি তো দেখলে সে ঘুমিয়ে ছিল। আমি ডাকলাম। ঘুমের ঘরে একবার আমাকে বলল, “আমি রাতে ঘুমাই নি। এখন ঘুমাবো।” বলার সাথে সাথে আমি যখন ধরলাম। তখন সে বলল, কথাটা সে ঘুমের ঘোরে ঘোরে বলেছে। ….আমি শিওর সে মিথ্যা বলছে।” ওর বাবা বলল, “মালিহা তোমাকে মিথ্যা বলছে? ইমপসিবল।”

আমি তর্ককরলাম না। বিষয়টা তর্কের নয়। সমাধানের, সিদ্ধান্তে আসার। বিষয়টা মাথা গরমের নয়, মাথা ঠান্ডা রেখে ভাববার। আমার মন বলল, মেয়ে আমাকে মিথ্যা বলেছে। কিন্তু আমি শিওর, সে আমার সামনে বেশীক্ষণ মিথ্যা কথা বলে টিকে থাকতে পারবে না। কিছুক্ষণ পরই আমি সত্যটা জেনে ফেলবো। আমি এমন মেয়ে জন্ম দেয়নি যে মেয়ে মিথ্যা বলে আামার সামনে টিকে থাকতে পারবে।

একজন মা- ৭

মেয়ে যে মিথ্যা বলে টিকে থাকতে পারবে না, তার একটা উদাহরণ দেই।

একদিন আমার এক কাজিনের বাড়িতে বেড়াতে গেছি। কাছেই বাড়ি। সেখান থেকে ফিরে দেখি, ওমা, ওর হাতে একটা ছোট্ট চাবির রিং। বিষয়টা অস্বাভাবিক লাগলো আমার কাছে। সাথে সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কি মালিহা?

মালিহা এমনভাবে তাকালো যেন এরকম একটা ব্যাপার ঘটবে ওর জানা ছিল না। বলল, মাথায় টুপি পরা দুটো বাবু। জড়াজড়ি করে আছে।

আমি বললাম, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু এটা তুমি কাকে বলে এনেছো?

“কেন অন্তরাকে বলে।”

অন্তরা আমার কাজিনের মেয়ে। বললাম, “অন্তরা তোমাকে দিয়ে দিলো?”

“হ্যা দিয়ে দিলো। আমি বললাম, ‘অন্তরা, এ জিনিসটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমাকে তুমি এটা দেবে?’ অন্তরা বলল, ‘হ্যা। নিয়ে যাও।’ আমি নিয়ে এসেছি।”

“কিন্তু মা এটাতো অন্তরার নয়। তাছাড়া, একটা কোন খেলনাও নয়। এটা একটা চাবির রিং। জিনিসটা নতুন। এটা তোমার নানাভাইদের কারো। খুব সম্ভবত: এটা একটা গিফট। তুমি এটা কোথায় পেয়েছিলে?”

“ডাইনিং টেবিলের ওপর পড়ে ছিল।”

“পড়ে ছিল না। বল রাখা ছিল।”

“হ্যা”

“তাহলে তুমি কেন বললে অন্তরার কথা? অন্তরাতো তোমাকে এটা দেয়নি”

“হ্যা মা দিয়েছে”

“মিথ্যা বলছো। তুমি এটা অন্তরার কাছে চাওনি। জাস্ট দেখেছো জিনিসটা সুন্দর। আসার সময় হাতে করে নিয়ে চলে এসেছো। অন্যের একটা জিনিস। কাউকে কিছু না বলে হাতে করে যে এভাবে নিয়ে আসা যায়না, তা তুমি জানো না?”

“জানি”

“তাহলে আনলে কেন?”

মেয়ে কোন কথা বলে না।

“এনেছো ভাল কথা। তোমার পছন্দ হয়েছে, ছোট মানুষ। এনেছো। কিন্তু আমি যখন জানতে চাইলাম সত্যটা, তখন মিথ্যা বললে কেন?”

মেয়ে কোন কথা বলে না। তার চোখ পায়ের দিকে।

আমি বললাম, “দ্যাখো মামনি, কারো জিনিস না বলে আনতে নেই। এই চাবির রিংটা এতক্ষণে ওবাড়িতে খোঁজাখুঁজি শুরু হয়ে গেছে। তাদেরতো ধারণাতেই আসবে না এই জিনিস তুমি হাতে করে নিয়ে আসতে পারো, বা, নিয়ে এসেছো। ছি ছি ছি কি লজ্জার কথা বলতো?”

মালিহা বলল, আম্মু, আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি আর এরকম করবো না। কিন্তু সে আরো এরকম ঘটনা দু’একবার ঘটালো। প্রতিবার সত্যটা বের করার পর বলে, আর এরকম করবে না। কিন্তু আবার সেই একই কান্ড করে।

অতিষ্ট হয়ে ওর বাবাকে বললাম, মালিহার বাবা, মেয়ের চিকিৎসা করাও। আমি আর পারছি না।

ওর বাবা রেগে গিয়ে বলল, ক্যাশের চাকরি করি। কোটি কোটি টাকার ডিলিংস। একটা সুতো এদিক ওদিক করি না। আমার মেয়ে এই রকম? জীবনে আমি কোন পাপ করেছি। তা না হলে আমার ঘরে আল্লাহ এরকম মেয়ে দেবেন কেন!

এই হয়েছে আমার আর এক অশান্তি।

তাকে কোন কিছু বললে, এমন বিলাপ শুরু করে দেবে সে! চুড়ান্ত অসহ্য। মাঝে মধ্যে ভাবি কিছু বলবো না। কিন্তু না বলেও তো পারিনা। বাবা সে। কোন দিন যদি বলে বসে! “কই আমাকে তো কিছু বলোনি!”

কিন্তু আমি দেখেছি সাংসারিক জীবনের জন্য যে মিনিমাম সেন্স থাকা উচিত। পুরুষ মানুষ হিসেবে রবির তা নেই। সে টাফ কোন স্ট্রেস নিতে পারে না। মানুষ হিসেবে তার ইনডেপথ ক্যাপাসিটিও বিলো স্টান্ডার্ড। ফলে আমাকেই শেষ পর্যন্ত বলতে হয়, “চুপ করতো তুমি”

“চুপ করবো?”

“না চুপ করবে না। বিলাপ করবে। লোক জানাজানি করবে। আর কি!”

“আজ না জানলেও কাল জানবে।”

“ওসব বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।”

“ঠিক হয়ে যাবে?”

“হ্যা যাবে, দেখো”

“গেলেই হয়।”

আমি মেয়েকে কোলের ভেতর টেনে নিতাম। বোঝাতাম। সিম্পল জিনিস। কোন কিছু যদি তোমার পছন্দ হয় আমাকে বলবে, আমি তোমাকে কিনে এনে দেবো। রাইট?

সাংসারিক জীবনের এইসব ছোটখাটো অশান্তির কথা কাকে বলবো আমি? আল্লাহকে ডাকতাম। বলতাম, আল্লাহ আমার মেয়েটাকে ঠিক করে দাও। সত্যি কথা বলতে কি, জানেন, আমার মন বলতো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।সেটি গেছে।

একজন মা- ৮

আশে পাশে খুব চুরি হচ্ছে।

কিছু দিন আগে মালিহার বাবার অফিসের এক কলিগের বাড়ি চুরি হলো। ভদ্রলোক থাকেন আমাদের বাড়ি থেকে দুটো বাড়ি পর। গিয়েছিলেন বাজারে, ফিরতে ঘন্টা দুইয়ের মত সময় নিয়েছেন। এসে দেখেন, সমস্ত বিছানাপত্র তছনছ, স্টিলের আলমারি খোলা। ওয়ারড্রবের কাপড়চোপড় ওলোটপালোট। তিনভরির মত স্বর্ণালঙ্কার, হাজার দশেক নগদ টাকা উধাও।

জানালার গ্রিল কেটে ভিতরে ঢুকে এই চুরি। ভদ্রলোক থানায় জিডি করলেন। কিন্তু ঐ পর্যন্ত। এই ঘটনার পর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সবাইকে একটি পত্র দিয়েছেন। অকপটে বলেছেন, বাড়ি পাহারা দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। কেউ যেন বাড়ি ফাঁকা না রাখেন। কোথাও গেলে কেউ যেন কাউকে বাড়িতে রেখে বের হন।

বেচারার আর কিছু থাক না থাক একটা সিনসিয়ারিটি আর অনেস্টি আছে। অন্তত: নিজের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করেছেন এবং এলাকার বাসিন্দাদের সতর্ক করেছেন । ফলে, রাতে থাকবো না, এমন হলেই, কাউকে না কাউকে আমি ঘরে রেখে যাই। কিন্তু যখনই ফিরে আসি দেখি ঘরদোর যার পরিস্কার রাখার কথা সেই রতনের মা ঠিক মত ঝাট দেননি, যে জিনিসটা যেখানে রাখার কথা সেই জিনিসটা সেখানে রাখেন নি। ফলে একদুপুর লাগে সেসব আমার ঠিক করতে। অনেক্ষণ হয়ে গেল সেই কাজ করছি। আর আগাপাশতলা ভাবছি। মাথা থেকে কিছুতেই চিন্তাটা যাচ্ছে না। মেয়ের মিথ্যাকথা বলার বিষয়ে ওর বাবা যতই বলুক “ইমপসিবল” আমি শিওর যে একটা রহস্য এর মধ্যে আছে। সেই রহস্যটা কি হতে পারে?

রাতে স্কুলের কোন বান্ধবি ওকে ফোন করতে পারে। কিন্তু কে সে? যার সাথে সারা রাত কথা বলেছে ও? বান্ধবি বলতে অনাবিলা আর মারুফা। অনাবিলা করবে না। কারণ ওদের ফ্যামিলি খুবই কনজারভেটিভ। ওর বাবা কুয়েটের প্রফেসর। ভদ্রলোক তবলিগ করেন। সাংঘাতিক আল্লাহওয়ালা মানুষ। রাত জেগে ফোনে খোশগল্প? অসম্ভব।

মারুফা মেয়েটা ক্লাশে ফাস্ট গার্ল। পড়াশুনায় অসম্ভব ভাল। ক্ষুরধার বুদ্ধিমতি। কিন্তু অত্যন্ত প্রতিযোগীতাপরায়ণ ও স্বার্থপর গোছের। মালিহার সাথে তার ইন্টিম্যাসি আছে। কিন্তু সেটি কি রাত জেগে খোশ গল্প করার মত?

ওর কাজিনদের ফেসবুকে একটা গ্রুপ আছে। মোবাইল হাতে নিয়ে মাঝে মধ্যে মালিহাকে দেখি হেসে গড়িয়ে পড়ছে। জিজ্ঞাসা করলে বলে, আম্মু গ্রুপের সাথে চ্যাটে আছি। গ্রুপের মেম্বর আমার তিন ননদের তিন ছেলেমেয়ে, আর আমার মেয়ে। মেজ ননদের ছেলে রুম্মন, ছোট ননদের ছেলে সাফিন আর আমার সেজ ননদের মেয়ে তাবাসসুম। তাবাসসুম মেয়েটা ইচড়ে পাকা। পড়ে ক্লাশ এইটে কিন্তু ভাবসাব অ্যাডাল্টদের মত। এডোলেসেন্সের বালাই নেই। সে এই গ্রুপের নাটের গুরু। সারারাত জেগে কি মালিহা ফেসবুকে গ্রুপ চ্যাট করলো? যদি সেটিই হয়ে থাকে তাহলেতো সর্বনাশ। রবি বলে, ফেসবুকের নেশা সাংঘাতিক।

ছোট মেয়েটাকে ঘুমপাড়িয়ে, মালিহার মশারি টানিয়ে বিছানা ঠিকঠাক করে দিয়ে এসেছি। একটা সিরিয়াল দেখতে দেখতে, রাতের খাওয়া দাওয়া করেছি । ওর বাবা আর আমি দাঁতব্রাশ করছি। সারাদিন যথেষ্ট ধকল গেছে। নো ফাজলামি আজ। কিন্তু রবি কি শুনবে? শুনবে নিশ্চই। এই একটা ব্যাপার। তার প্রতি আস্থা রাখা যায়। আমার শরীরের প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধাবোধ।

মালিহা বলল, আম্মু ফোনটা দাওতো।

আমি বললাম, কেন? ফোন দিয়ে কি করবে?”

“এই একটু কাজ আছে।”

“কাজ আছে মানে?”

“বললামতো একটু কাজ আছে।”

“কি কাজ আমাকে বলবে তো?”

“তোমাকে বলা গেলেতো বলতাম”

“মানে?”

“মানে বুঝতে পারছো না? তোমাকে বলা গেলেতো বলতাম”

“সে এগেন”

মেয়ে হতভম্ব নয়, ক্ষুব্ধ। সে চোখ পাকিয়ে কেউটে সাপের মত ফুসতে শুরু করলো। কি আশ্চর্য! মুহুর্তেই কপালের চামড়া কুচকে গেল তার। অবাক নই আমি, রিতিমত হতভম্ব। শরীরের সমস্ত রক্ত মগজে উঠে এল। বেশ বুঝতে পারছি চেহারায় সেটি প্রকাশও পাচ্ছে। কিন্তু মেয়ে সেটিকে মোটেই পাত্তা না দিয়ে বলল, ফোনটা দেবে না? ….জাস্ট বল দেবে কি দেবে না? ইয়েস অর নো।

একজন মা-৯

আমি মশারির বাইরে এসে ঠাস করে একটি চড় বসিয়ে দিলাম মেয়ের গালে।

এতেই পৃথিবী উল্টে গেল। তার চোখ আরো বড় বড় হয়ে গেল। বেশ বোঝা যায়, সে আশা করেনি আমি তার গায়ে হাত তুলতে পারি। কিন্তু কতক্ষণ আর মাথা ঠিক রাখা যায়? কতক্ষণ একজন মা পারবেন মাথা ঠিক রাখতে?

আমরা যারা মিনিমাম লেখাপড়া করেছি, একটা কালচারাল পরিবেশে বড় হয়েছি, একথা বলি বাচ্চাকাচ্চার গায়ে হাত তুলতে নেই। বলি ঠিকই, কিন্তু কতজন সেই আলোকপ্রাপ্ত, জ্ঞানী, আর ধৈর্যশীল মানুষের মত আচরণ করতে পারি? প্রয়োজনের মুহুর্তে ধৈর্য্য আর সহনশীলতার পরিচয় দিতে পারি? প্রচন্ড রাগের মুহুর্তে মাথা ঠিক রাখতে পারি?

রবি বাবা সন্তান শাসনের ব্যাপারে কখনো সামনে আসে না। বলে, তাতে নাকি অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নষ্ট হয়। মেয়েদের আমি যাই বলি না কেন সে আমার পাশে এসে দাড়ায়। বলে ঠিক আছে। আমি অবশ্য, আমার অভিজ্ঞতায়, অনেক সময় দেখেছি বাচ্চাদের বাবা বা মা কেউ একজন বকা দিলো, অন্যজন এসে সাথে সাথে সন্তানের পক্ষ হয়ে আল্লাদে গদ গদ হয়ে পড়েন। আমাদের দু’জনের কেউই আমরা তেমন না। এ ব্যাপারে আমাদের মধ্যে একটা ভাল বোঝাপড়া আছে।

চড় খেয়ে মালিহা চলে গেলেও, ওর রণমুর্তীটা আমার পছন্দ হলো না। ওর চলে যাওয়ার ধরণ, দরজাকে সজোরে পিছনে ঠেলে দেওয়ার বিষয়টা- এসবের কোন কিছুই সহ্য করতে পারলাম না। কয়েক মুহুর্ত ওভাবে দাড়িয়ে থেকে আমি ওর ঘরে গেলাম। ইতিমধ্যে ওর বাবাও মশারি ভেতর থেকে বাইরে এসেছে। সেও আমার সাথে মালিহার ঘরে এসে দাড়িয়ে রইল আমার পাশে। মাথা গরম করে ফেলেছি, মাথাতো গরম করলে চলবে না। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। প্রাণপণে নিজেকে কন্ট্রোল করতে সৃষ্টিকর্তার কাছে শক্তি প্রার্থণা করলাম। তারপর খুব স্থিরভাবে আমি বললাম, “তুমি এমন অস্বাভাবিক আচরণ করছো কেন, মালিহা?” মেয়ে তখন অগ্নীমূর্তী। সে বলল, “আমি কিছু করছি না। যাও।”

“না না তোমাকে কথা বলতে হবে, মা”

“আমি কোন কথা বলবো না।”

“কথা বলবা না বললে তো হবে না মামনি। একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরী করে এখন যদি বল কোন কথা বলবে না। তাহলেতো হবে না। বল কি হয়েছে? কাল রাতে কি করেছো? ঘুমাও নি কেন?”

মালিহা আমার দিকে তাকালো। অবাক। সে হয়তো ভেবেছিল বিষয়টা ধামাচাপা পড়ে গেছে। আমি আর এ নিয়ে কোন কথা বলবো না। কিন্তু আচমকা বিষয়টি উত্থাপন করায় সে হতচকিয়ে গেল। ওর বাবা আমার পাশে দাড়িয়ে নিশ্চুপ। সে হতবাক। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। অসহায় গলায় সে শুধু বলল, তোমরা আস্তে কথা বল। আশে পাশে অনেক মানুষ। এমন কিছু করনা যেন আমাদের মানসম্মান চলে যায়। আমরা যেন আর দশটা ফ্যামিলির মত গণ্য না হই।”  আমি তার দিকে এক নজর তাকিয়ে মেয়ের দিকে ফিরলাম, “হ্যা বল মালিহা। কাল কি করেছো? সারা রাত জেগে ছিলে কেন? আর আজই বা কেন তোমার ফোনটা দরকার ছিল। বল।”

“আমার আর ফোন দরকার নেই। বললাম তো। আর শোন, কাল আমি রাত জেগে কিছু করিনি। ঘুমিয়েছি। আর কতবার বলবো এক কথা?

“তুমি এত জোরে দরজা আটকালে কেন? প্লাস্টিকের দরজা। তুমি জাননা?”

“জানি”

“তাহলে?”

“ভেঙে গেল যেতো”

“মানে”

“তুমি আমাকে মারলে কেন শুধু শুধু?”

“বারে! আমি তোমাকে শাসন করতে পারবো না?”

“আশ্চর্য! সন্তানকে আমি শাসন করতে পারবো না? সেজন্য আমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে?”

মালিহা কি যেন বলতে যাচ্ছিলো, আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, শোন, আমি তোমার মা, তোমার কাছে কৈফিয়ত দিতে আমি  বাধ্য নই। যেদিন মা হবে সেদিন বুঝবে।” এইরকম তর্কচলতেই থাকলো।

আমি একটা বলি মেয়ে আর একটা বলে। আমি যত মূল জায়গায় আসতে চাই, মেয়ে তত এদিক ওদিক দিয়ে যায়। কিছুতেই তার নাগাল পাইনা। শেষে নিরুপায় হয়ে, আমি স্ট্রাটেজি চেঞ্জ করলাম। মেয়েকে কাছে টেনে নিলাম। প্রথমে সে জোরাজুরি করছিল, কিন্তু আমার জোরের কাছে ও আন্তরিকতার কাছে সে হার মানলো। কাছে টেনে বুকের মধ্যে নেওয়ার সাথে সাথেই মেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। আমাকে শক্ত ভাবে জাপটে ধরলো। আমি নিজেও তখন কেঁদে ফেললাম। কোত্থেকে যেন একটা কষ্ট গলার কাছে ব্যথা হয়ে উঠে এল।

আমি বললাম, মামনি তুমি একটি ক্রাইসিস ফেস করছো। অস্বাভাবিক আচরণ করছো। তুমি বুঝতে পারছো না। আমাকে তুমি বিষয়টা বুঝতে দাও। কি হয়েছে আমাকে তুমি বল। তুমি যদি আমাকে না বল আমি কি করে বুঝবো? অনেক বেশী জটিল হয়ে যাওয়ার আগে আমাকে বল। তখনই মেয়ে কথাটা আমাকে বলল।

একজন মা-১০

আজকালকার ছেলেমেয়েরা একটু বেশী অ্যাডভান্সড, একটু বেশী ইনফর্মড আর মডার্ন। তাদের অ্যাডভান্সনেস বা মর্ডানিটিটা আপনাকে কখনো কখনো হতভম্ব করতে পারে। এমন অবাক করতে পারে যে, আপনি ভেবেই কিনারা করতে পারবেন না, একটা কোন ক্রাইসিসের সময়, আপনি ঠিক কি করবেন।

রাগ করবেন? অভিমান করবেন? দেয়ালে মাথা ঠুকবেন? নাকি হা হা করে হেসে উড়িয়ে দেবেন? নাকি বিরক্ত হয়ে মনে করবেন অতিতে আপনি কোন পাপ করেছেন যার ভোগান্তি এটা? নাকি, আপনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলবেন, কোন জামানা এটা? আপনি যাই করুণ, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি আপনাকে অনুরোধ করবো, প্লিজ, মাথাটা জাস্ট গরম করবেন না। রেগে গেলেন তো আপনি হেরে গেলেন*।

অবশ্য, স্বভাব বা শিক্ষাবশত: আপনি হয়তো আপনার সময়ের সাথে বর্তমান সময়টাকে তুলনা করতে চেষ্টা করবেন। কিন্তু সেটি হবে আর একটি ভুল। আপনার আমার কল্পনার চেয়েও দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে আমাদের সমাজ! আমাদের সংস্কৃতি। আমাদের ঐতিহ্য।

এই পাল্টে যাওয়াটা কাঙ্খিত নাকি অনাকাঙ্খিত, সে তর্ক অনেক পরের ব্যাপার। চ্যালেঞ্জটা হলো মা হিসেবে আপনার আমার টিকে থাকার বিষয়টি। স্টেপিং ঠিক রাখা না রাখা নিয়ে। করণীয় নির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ সম্পর্কীত- আমি কি করবো, তাই।

আমি যখন সানন্দা পড়তাম, কোন ননফিকশন বই পড়তাম, রবি আমার সমালোচনা করতো। হাসাহাসি করতো। বলতো, আমি মুখস্ত করছি, বলতো প্রয়োজনের সময় ওসব কোন কাজে লাগেনা। কিন্তু আমি যদি, নাই জানি প্রাথমিকভাবে আমাকে কি করতে হবে, আমার জন্য তো আরো সমস্যা। এবং অধিকাংশ বাবা মায়ের ক্ষেত্রে সম্ভবত: তাই হয়ে থাকে। তারা বুঝতেই পারেন না কিভাবে বাচ্চাকে সামলাবেন। কথায় কথায় বিশেষজ্ঞ মানুষের কাছে যাওয়াতো আমাদের সবার পক্ষে সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাইনা?

তথ্যের অবাধ প্রবাহের যুগ এটা। বাচ্চাকাচ্চার ওপর নজরদারি বাড়িয়ে কি তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? আমি যদি বলি ‘এটা বন্ধ’। আমার সন্তান কি আমার চোখের আড়ালে গিয়ে সেটি খুলে বসবে না? আমি তাকে কতক্ষণ চোখে চোখে রাখবো? বাচ্চাকাচ্চা কি সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখা সম্ভব?

তাহলে মানেটা পারফেক্টলি কি দাঁড়ালো? আমাকে আপনাকে সবকিছু খুলে রেখেই সারাক্ষণ খেয়াল রাখতে হবে। তাইতো? অর্থাৎ সারা দুনিয়া চামড়া দিয়ে মুড়ে রাখার চিন্তা আসলে বাতুলতা। বেটার একজোড়া জুতো কেনা।

হ্যা এটাই হলো চ্যালেঞ্জ। নিজের জন্য একজোড়া জুতো কেনা। যে জুতো পাপপঙ্কিলতা থেকে আপনার পা’জোড়াকে রক্ষা করবে। বলবেন, এই কাজটা অনেক কঠিন। কঠিন যে, সে আমার থেকে আর কে ভাল জানে? অবশ্য, অনেকে আমার সাথে একমত হবেন না। বলবেন, আমি হাই সোসাইটির মানুষের মত কথা বলছি। কিন্তু বিশ্বাস করুণ এটাই বাস্তবতা।

ফলে, আমার টিন এজ মেয়ে যখন ‘সমস্যার কারণ হিসেবে’ একটি ছেলের কথা বলেছে, বলেছে যে, ছেলেটা তাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। অবাক হলেও আমি আমার আচরণে তার প্রকাশ দেখাইনি। বিস্মিত হলেও মুখে সে কথা তাকে বলিনি। একবারও ভাবিনি আমার মেয়ে ক্লাশ সেভেনে পড়ে নাকি সিক্সে। বিষয়টাতো আমার, আমার মেয়ের, তাইনা? আমাকেই তো সবকিছু সামলাতে হবে, তাইনা? সো আমি মালিহাকে শুধু বলেছি, ইনভাইট হিম হোম।

একজন মা-১১

ছেলেটাকে বাড়িতে আসতে বলার পেছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল, গোটা ব্যাপার টাকে ঘরের বাইরে থেকে চোখের সামনে আনা। স্কুলের খাতা কলমে বয়স যাই থাক আমার মেয়ের প্রকৃত বয়স ১৩। পড়ে ক্লাশ সিক্সে। যে ভাইয়াটা তার চিন্তার কারণ হয়েছে সেও বড়জোর ওর থেকে হয়তো দুচারবছরের বড় হবে। এর বেশীতো আর না? সেও তো কোন না কোন মায়েরই সন্তান। তো এরকম বয়সের দু’টো ছেলেমেয়েকে আমি রাস্তাঘাটে ছেড়ে দিতে পারি না। পারি বলুন?

তাছাড়া, ব্যক্তিগতভাবে, আমার উদ্দেশ্য ছিল আমার মেয়েকে চিন্তায় ফেলার কারণ আবিস্কার। আমার মেয়ে বলেছে সে সুইসাইড নোট লেখে। যদি তার কারণে কিছু হয়ে যায়? অর্থাৎ একধরণের ভিতি আমার মেয়েকে দুর্বল করেছে। ভিতি রুপান্তরিত হয়েছে ভালবাসায়। সম্পর্কের ভিত হিসেবে বিষয়টা খুবই পলকা। ভিতি যেদিন থাকবে না সেদিন ভালবাসা ছুটে যাবে। অবশ্য, উল্টোটাও হতে পারে। ভিতি একদিন ভয়ঙ্কর ভালবাসায় রুপ নিতে পারে। তখন আমার মেয়ের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। যাহোক, স্পেসিফিক ঠিক কোন কারণে আমার মেয়ে তাকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গিয়েছে আমি সেটি জানতে চাই।

দ্বিতীয়ত: এ জাতীয় সম্পর্কের ন্যাচারালি দুটি দিক থাকে। Love and Lust যেমন সবক্ষেত্রেই থাকে ভাল মন্দ। এটা কি শ্রেফ অ্যাট্রাকশন আর ক্লোজনেস- যার পরিণতি টিনএজ ডেটিং? নাকি এর মধ্যে কমিটমেন্ট আছে আমি তা বুঝতে চাই।

ওদের স্কুল ছুটি হয় বারোটা ত্রিশে। আমি মালিহাকে বললাম, তুমি ওকে স্কুল ছুটির পরপরই আসতে বল। বলবে আমি একটু কথা বলতে চাই।

কিন্তু রাতে রবির সাথে এ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কিছুটা দ্বিধা তৈরী হলো। লাইট অফ করার সাথে সাথেই সে পাশ ফিরে কানের কাছে আমার মাথার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বলল, “তুমি কেন এই উটকো যন্ত্রণা ঘরে আনছো, বলতো”

আমি বললাম, দ্যাখো, কো এডুকেশন স্কুল। আমরা যদি বাসায় বিষয়টাকে এন্টারটেন না করি তাহলে স্কুলে ওরা সুযোগ খুঁজবে। এবং সুযোগ ওরা করেই নেবে। তুমিআমি আটকাতে পারবো না। রয়েছে মোবাইল, ইন্টারনেট, ফেসবুক। চোখের সামনে যদি বিষয়টা থাকে, কিছুটা হলেও তাতে সংযম থাকবে। খুব বেশী রিস্কি কিছু করার ব্যাপারে ওরা বাইন্ডিংসএর মধ্যে থাকবে। তাছাড়া-

তাছাড়া কি?

এতো খানিকটা উঠলো বাই দরগায় যাই টাইপ

মানে?

মানে এর তো কোন ভবিষ্যত নেই।

কি বল তুমি?

আরে দুর। তোমার দোদুলের কথা মনে নেই? দোদুল। তোমার ভাইপো। চাচাতো ভাইয়ের বড় ছেলে। পাগল হয়ে গেছিলো একটা মেয়ের জন্য। তারপর? বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কি হলো? সেখানে একটি মেয়ের সাথে জড়ালো। থাকলো কিছুদিন পর সে আবেগ? তারপর চাকরি পেয়ে বিয়ে করলো কাকে? …..শোন, আমি খুব ভাল ভেবে দেখেছি। খুব ক্ষণস্থায়ী এসব। কিন্ত মজার ব্যাপার কি জানো। এসব সম্পর্কের ধকল মেয়েরা যতটা পোহায় ছেলেরা ততটা না। আমার যদি ছেলে হলে হতো আমি চিন্তা করতাম না। কিন্তু আমার তো মেয়ে। সমাজ বলেও একটা কথা আছে। দাগ একটা মেয়ের জন্য যতটা দগদগে হয়ে দেখা যায় আমাদের সমাজে একটা ছেলের ক্ষেত্রে তা যায় না। ঘরে সুযোগ না দিলে ঐ ছেলে স্কুল থেকে ফেরার পথে মেয়ের পিছু পিছু বাড়ি পর্যন্ত আসবে। তাতে এলাকার মানুষের চোখে পড়বে। মফস্বল এলাকা। অল্প বয়সে মেয়ের বদনাম হবে। ঝামেলা বাড়বে ছাড়া কমবে না।

তুমি বিষয়টা নিয়ে মনে হচেছ অতিরিক্ত চিন্তা করছো। স্ট্রেট কেন বলছো না যে এসব চলবে না?

আশ্চর্য তুমি এতক্ষণ পর এই বলছো?

আমি যা বলছি চিন্তাভাবনা করেই বলছি।

মোটেও না। বলতে হয় তাই বলছো। এই তোমার চিন্তাভাবনার বহর?

মানে?

যদি ভেবেও থাকো তাহলেও তুমি শুধু তোমার মেয়ের দিকটা ভাবছো। শুনেছো ছেলেটা দুর্বল, সুইসাইড নোট লেখে। যে কারনে এভাবে কথা বলছো। কিন্তু মালিহার বাবা, দুর্বল কিন্তু তোমার মেয়েও যে কোন সময় হয়ে পড়তে পারে। একটা গোটা রাত যে মেয়ে জেগে জেগে ফোনে কথা বলতে পারে। তারপক্ষে অনেক কিছুই সম্ভব। তুমি শুধু মেয়েকে সেভ করাতে মরিয়া। কিন্তু আমি দুটোকেই সার্ভাইভ করাতে চাই। মা আমি।

একজন মা-১২

“আর শোনো, তুমি একটা কথা বলেছো খুবই আপত্তিকর। বলেছো, “তুমি বিষয়টা নিয়ে মনে হচেছ অতিরিক্ত চিন্তা করছো।” এই কথাটা কেন বললে? আমি চিন্তাভাবনা করবো না? তাহলে কে করবে? একটা রাতে মোবাইলে কথা বলে আমার ১৩ বছরের মেয়ে রাত পার করে দিচ্ছে আমি তা নিয়ে অতিরিক্ত চিন্তাভাবনা করবো না? দোদুলরা যেমন আছে দুনিয়ায়। তেমনি কিন্তু সোফিয়া লোরেনের মত মানুষও আছে। বিয়ের পর পর তুমিই কিন্তু সান ফ্লাওয়ার ছবিটা এনে দেখিয়েছিলে আমাকে মনে আছে?

“সান ফ্লাওয়ার?”

“হ্যা সান ফ্লাওয়ার। কিসের গল্প যেন?

“ভালবাসা আর বিচ্ছেদের গল্প।”

“যাঃ। সেতো যুদ্ধের কারণে মানুষের মধ্যে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয় পাঁচালি। ওখানে তুমি প্রেমবিরহটা মুখ্য হিসেবে দেখলে?”

“দ্যাখো, মালিহার বাবা, টিনএজ থেকেও কিন্তু সিরিয়াস সম্পর্ক তৈরী হতে পারে। সেকেন্ড ওয়ল্ড ওয়ারের সময়ের একটা ঘটনা শোন। হাই স্কুল পার হওয়ার সাথে সাথেই দেখা গেল মেয়েরা দলে দলে বিয়ের পিড়িতে বসতে শুরু করছে। তখন থেকে বিয়ের অ্যাভারেজ বয়স উপরে উঠে গেল আর পিউবার্টির অ্যাভারেজ বয়স নিচে নেমে গেল। বিষয়টা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে হয়তো ছেলেমেয়েরা লাইফপার্টনার খোঁজার থেকে ডেটিংটাকে ফান হিসেবে নিচেছ। কিন্তু এটা এমন না যে, কেউ তাদের প্রথম প্রেমকে মিস করে না। কেউ কেউ আছে না? সারা জীবন পার করে দেয় এটা ভেবে যে, আহ কি হতে পারতো! আমি তোমাকে একটা পরিসংখ্যান দেই। ১৮ থেকে ৯২ বছরের ১৬০০ ছেলেমেয়েদের মধ্যে গবেষণায় দেখা গেছে চারভাগের একভাগ তাদের ফাস্টলাভের কাছে প্রত্যাবর্তন করে”

রবি আমার চুলের ভেতর থেকে আঙুল সরিয়ে নিলো। “তুমি ঘুমাও। তুমি আমার লিবিডোটা নষ্ট করে দিলে।” বলতে বলতে সে পাশ ফিরে শুলো। “তুমি ঘুমাও। আমি বুঝতে পেরেছি। কাল আমার অফিস আছে। তোমার পরিসংখ্যান নিয়ে তুমি ভাবো। শুধু দেখো “বিষয়টা খাল কেটে কুমির আনার মত পরিস্থিতি যেন না হয়। আমার আর কিছু বলার নেই।”

“এই শোন শোন। কিছু বলার নেই মানে? মেয়ের যখন বিহেভিয়ারাল প্রবলেম হচ্ছিলো আমি বলেছিলাম মেয়েটাকে নিয়ে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখানোর কথা। তুমি কি বলেছিলে? বাদ দাওতো ওসব, আমরা মিডিলক্লাশ ফ্যামিলি আমদের ওসব মানায় না। জীবনটা নাটক সিনেমা না। পরে কিন্তু তুমিই অতিষ্ট হয়ে গিয়েছিলে। শেষপর্যন্ত সমস্যাটাকে আমিই সলভ করেছি। গরিব নেওয়াজ ক্লিনিকে সপ্তাহে একদিন বসা ঢাকার সেই ডাক্তারকে কিন্তু আমি খুজে বের করেছিলাম।”

“তো?”

“পাশ ফিরে শুয়ে থাকা মানুষকে তার কথার উত্তর দিতে আমি বাধ্য নই।

কি বললে?

বলছি পাশ ফিরে শুয়ে থাকা মানুষকে তার কথার উত্তর দিতে হবে এমন দাসখত দিয়ে আমার বাবা মেয়ে বিয়ে দেয়নি।”

“আমি তোমার কাছে মাফ চাই। তুমি ঘুমাও। তোমাকে কোন কথার জবাব দিতে হবে। আমার যা বোঝার আমি বুঝে গেছি।”

“আজ আর কিছু হচ্ছে না। তাই না?”

“ইয়েস”।

একটা অদ্ভুত মানুষের সংসার করি আমি, জানেন। আমার হাজবেন্ড ওই কথা বলে সত্যি সত্যিই ঘুমিয়ে পড়লো। একটু পরই যখন তার ভারি নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পেলাম আমি নিশ্চিত হলাম সে গভীর ঘুমের অতলে নেমে পড়েছে। মাঝে মাঝে মনে হয় দিই ঘুম ছুটিয়ে। তাজা ঘুম ভাঙিয়ে অহেতুক কথার জালে আটকাই। আমি কথা বলছি আর সে শুয়ে পড়বে কেন? কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি, শারিরিক মেলামেশার গন্ধহীন সময় সে শুয়ে শুয়ে পার করতে পারে না। অন্তত: রাতের বেলা না। অকপটে সে স্বীকারও করে। বলে, দ্যাখো, রাত জাগলে শরীর খারাপ করবে। ঘুমাও। ভাবা যায়, এই মানুষটা এনগেজমেন্টের পর বিয়ে আগের সময় টাতে লম্বা লম্বা চিঠি লিখতো। সেই চিঠিতে আমি তার যে আবেগ দেখেছি, যে উচ্ছাস দেখেছি, বিয়ের পর উল্টোটা দেখেছি। কেন উবে গেল সেই আবেগ তা আমার অজানা। আজ অজানা কিন্তু একদিন আমি ঠিক জেনে যাবো। আমার হাইপো থিসিস বলে, অ্যাভারেজ পুরুষ মানুষই এমন। একটা সম্পর্ক থেকে বিয়ের পিড়িতে বসা অ্যাভারেজ পুরুষ মানুষই তাদের গুরুত্বপূর্ণ দিনসমূহ বিয়ের পর আর মনে রাখতে পারেন না। যেমন কোনদিন স্পাউসের জন্মদিন, কোনদিন তাদের ম্যারেজ ডে, এনগেজমেন্ট ডে ইত্যাদি। বিয়ের আগে, আমরা মাস ছয়েক সময় পেয়েছিলাম। রবি সম্পর্কে আমার অ্যাসেসমেন্ট ‍সুপারফিশিয়াল না। পারফেক্ট।

একটা উদাহরণ দেই।

https://www.google.com/?gws_rd=ssl#q=Teen+age+love+facts+and+findings+

http://www.livestrong.com/article/1004583-interesting-teen-love/

http://love.allwomenstalk.com/things-teenage-girls-should-learn-about-love

http://classroom.synonym.com/interesting-teen-love-22806.html

https://www.psychologytoday.com/blog/sticky-bonds/200906/teenagers-in-love

http://www.cracked.com/

article_20204_5-psychology-studies-every-awkward-teenager-should-read.html

একজন মা-১৩

বিয়ের প্রথম বছর রবি প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ তারিখ ভুলে গেল।

প্রথম ভুলে গেল জন্মদিনের তারিখ, বলল, সরি টুম্পা ভুলে গেছি। বলেই, অফিস থেকে একটু আগে চলে এল। আপনি অফিস থেকে টাইমলি আসলেন নাকি দেরি করে আসলেন সেটা কোন বিষয় নয় আপনি ভুলে গেছেন সেটাই হলো বিষয়।

দ্বিতীয় ভুলে গেল এনগেজমেন্টের তারিখ। আমি ফোন করলে, আমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলল, আশ্চর্য মানুষতো তুমি। বলবে না একবার? আমি বললাম, কেন? বলবো কেন?

আশ্চর্য আমাকে তুমি একটা বার মনে করাবে না?

না এটা একটা বার মনে করানোর বিষয় নয়। এটা সবসময় মনে রাখার বিষয়।

পার্থক্য হলো কি ?

অনেক পার্থক্য হলো।

কি

সেটা ফোনে বলা সম্ভব না।

আমি ফোন কেটে দিলাম।

তৃতীয় ভুলে গেল বিয়ের তারিখ, আমি আভাসে ইঙ্গিতে বহুত চেষ্টা করলাম শোবার আগে। দেখি সে মনে করতে পারে কিনা। না পারলো না। সকাল বেলা উঠে, আমার সাথেই সে উল্টো মেজাজ দেখাতে শুরু করলো।

একবার নয়, অনেক বার এমন হয়েছে। এনগেজমেন্টের তারিখ, বিয়ের তারিখ, আমার জন্মদিনের তারিখ। ভুলে গেছে সে। প্রতিটি দিনের শেষে যখন রাত নেমেছে, আমি এটা সেটা বলে তাকে জাগিয়ে রেখেছি। ক্ষিণ আশা নিয়ে, দেখি সে বলে কিনা। না সে মনে করে বলেনি। হ্যা, এটা স্মরণশক্তির একটা ব্যাপারতো বটেই। তবে তার চেয়ে বেশী আগ্রহের ব্যাপার। যতটা আগ্রহের ব্যাপার, তার চেয়ে বেশী দায়িত্ববোধের। দায়িত্ববোধ দাম্পত্য সম্পর্কের প্রাণ। বিয়ের আগে একটা লোক দিনতারিখ মনে করতে পারছে বিয়ের পর পারছে না। এটা যখন কেস, তখন তাকে স্মরণ শক্তির ব্যাপার বলে খাটো করে দেখা কি ঠিক? দাম্পত্য জীবনে এই আপাত: ক্ষুদ্র বিষয় নিয়েও বড় ধরণের বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। ঘটেও। আমার ক্ষেত্রেই ঘটেছে। আমার মনে হয়েছে এই মানুষটা অমানুষ। মুখোশধারী। খামখেয়ালি। কোন কোন সময় ভিষণ রাগ হয়েছে। কিন্তু রাগ হলে কি হবে! কি করবো আমি? এটা তো আর ওয়েস্টার্ন সেটিং না। এটি ওরিয়েন্টাল সেটিং। কম্প্রমাইজ শব্দটা এখানে কাজ করে সম্পর্কের আঠা হিসেবে। আমি সেই আঠা লাগিয়ে সম্পর্ককে টেনে নিয়ে যাচ্ছি। যখন জেনেছি অর্ধেক পুরুষেই এসব পারে না। আর এই না পারার পিছনে কাজ করে তাদের এক্সটারনাল চাপ। যখন জেনেছি মেয়েদের থেকে ছেলেরা সাধারণত হয়ে থাকে ফরগেটফুল। রাগ থাকেনি আর।  যাগগে, আমি নাহয় সম্পর্কের দামে সুখ খোঁজা মানুষ, ভালবাসতে গিয়ে খুঁজে গিয়েছি অবলম্বন। অনবরত। আমাদের ছেলেমেয়েরা? তারা কি করবে? তারা কোন্ ঘটনায় কেমন রিঅ্যাক্ট করবে?  দেখুন, জীবনে আমার অনেক কিছু দেখার ও শোনার করার বাকি ছিল।

পরের দিন স্কুল ছুটির পর ছেলেটা যথাসময়েই এল আমাদের বাড়িতে। মেয়ের কাছে আগেই নাম শোনা ছিল। বললাম, বস পান্থ।

মাই গড! এই ছেলেতো দেখতে সুবিধার না! পাতলা ছিপছিপে একটা ছেলে। গায়ের রং চাপা। কিন্তু আমি সহজে ধৈর্য হারানো মানুষ না। মনে পড়লো, আমার মেয়ের কোন অ্যাট্রাকশনতো এই অ্যাফেয়ারে কাজ করেনি। সেই আমার মেয়েকে ইমোশনাল ব্লাক মেইলিং করেছে, অন্তত: এখনো পর্যন্ত যা জানি। অতএব, ছেলেটা অসম্ভব বুদ্ধিমান তো বটেই, সে কথার যাদুকরও। অল্পবয়সি মেয়েদের বাস্তববুদ্ধি থাকে কম। তাদের কাজ বর্তমান নিয়ে মেতে ওঠা। ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তাভাবনা করা নয়। কথার যাদু একটা বড় বিষয় সেখানে। আমি তাকে ড্রইং রুমে বসতে বলে কিচেনের দিকে গেলাম। মালিহাকে বললাম, তুমি তোমার ভাইয়ার সাথে কথা বলতে থাকো। আমি ওর জন্য একটু নাস্তা আনি। “না না আন্টি আমি কিছু খাবো না।” বলতেই আমি তাকে থামিয়ে দিলাম, “তুমি বস।”

কিচ্ছু না, জাস্ট দুটো সাগর কলার মুখ চপিং বোর্ডের উপর রেখে ছুরি দিয়ে কেটে ফেললাম। নিজের বানানো দুই পিস কেক একটা প্লেটে রেখে মেয়েকে বললাম, মামনি ট্রে টা নিয়ে এস। আর হ্যা, গ্লাশ ধুয়ে এক গ্লাশ পানি।।” ও গেল আনতে। আমি কথা শুরু করলাম।

“পান্থ তোমরা কয় ভাইবোন?”

“একভাই এক বোন।”

“তুমি?”

“আমি ছোট”

“তোমার বোন?”

“আমার বোন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।”

“কোন সাবজেক্ট?”

“কম্পিউটার সায়েন্স”

http://www.automaticromantic.com/articles/article/why-do-men-forget-birthdays-and-anniversaries/

http://www.dailymail.co.uk/news/article-1382044/Survey-reveals-half-men-know-wedding-anniversary.html

http://www.observer.ug/lifestyle/73-people-society/32453–do-men-deliberately-forget-their-partners-anniversaries

একজন মা- ১৪

“ভাল। আমার এক বোন পড়তো একসময় এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সে।”

“কোন্ ব্যাচ?”

“এটাতো বলতে পারবো না, তবে ওরা ২০০৫ এর দিকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বেরিয়েছে।”

“বাবা সে তো অনেক আগে”

“হ্যা অনেক আগে। আমার ছোট বোন।”

পান্থ বলল, “পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়টা একটু অন্যরকম।”

“হ্যা অন্যরকম। সবাই তাই বলে”

“রাজনীতি নেই। পড়ালেখাটা টাইমলি শেষ হয়ে যায়।”

“হ্যা রাজনীতি নেই। পড়ালেখাটা টাইমলি শেষ হয়ে যায়।

কয়েকমুহুর্ত চুপচাপ।

একসময় আমি বললাম, ওখানে আমার একটা ভাগনেও পড়তো।”

“তাই নাকি?”

“হ্যা। ওরা বের হয় ২০০৪ এর দিকে।”

“বাবা সেও তো অনেক আগে”

কিছুক্ষণ আবার কোন কথা নেই। দুজনেই আমরা চুপচাপ।

এই সময় মালিহা ঢুকলো ট্রে হাতে। আস্তে আস্তে খাবারদাবার গুলি নামিয়ে রাখলো। গ্লাশটা ধুয়েই এনেছে দেখলাম, ধুয়ে আনতে বলেছিলাম। আমি তাকে বললাম, তুমি তোমার ঘরে যাও মা। মালিহা কোন কথা না বলে ওর ঘরে চলে গেল। আমি পান্থর দিকে ফিরলাম, খাও।

পান্থ বলল, আপনি শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলেন আন্টি।

না না এ আর এমনকি। খাও।

আমি তো বললাম আমি কিছু খাবো না।

আরে খাওতো।

না না আন্টি আমি কিছু খাবো না।

পান্থ কিছু মুখে না দিয়েই পানির গ্লাশটা শেষ করে ফেলল। ঢক ঢক করে পানি খেয়ে বলল, “আপনার ভাগ্নে আর আর আপনার ছোট বোন প্রায় সমবয়সি তাইনা?”

“হ্যা প্রায় সমবয়সি। আামার জন্মের এক বছর আগে আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছিল।”

এই কথার পর কোন মন্তব্য করলো না। এই ছেলে ক্যালকুলেটিভ। ক্যালকুলেটিভ ছেলেদের লজ্জাশরম কম থাকে। মুখের উপর সোজাসাপটা কথা বলতে পারে তারা। সেটা খারাপ না। আজকাল মুখের উপর কথা বলার যুগ। নিজের টা নিজে বুঝে নিতে না পারলে কেউ কাউকে কিছুই বুঝে দেয় না। আমি অবশ্য এমনিতেই কথাবাত্রায় সতর্ক সবসময়, কিন্তু নিজেকে আরও একটু সতর্ক করে রাখলাম।

“তোমার বাবা চাকরি করেন, নাকি বিজনেস?”

“চাকরি।”

“কোথায়?”

“খুলনাতে।”

“না না আমি আসলে জানতে চেয়েছি কিসের জব?”

“ও আচ্ছা। এটা একটা মেডিসিনের কোম্পানি। বাবা মার্কেটিং এ আছেন ”

“আচ্ছা”

“আমার বাবা ঘন ঘন চাকরি পাল্টান”

“ওমা তাই নাকি?”

“কেন?”

“সুবিধার জন্য”

“ও আচ্ছা”

“কিন্তু আমার মা তা নন। আমার মা খুব স্ট্রিক্ট। তিনি প্রতিষ্ঠান চেঞ্জ করা পছন্দ করেন না। জাপানিদের মত।”

“জাপানিদের মত মানে?”

“জাপানিরা এক প্রতিষ্ঠানে সারা জীবন পার করে দেন।”

“কি রকম?”

“ওদের ওখানে কাজের পরিবেশ একই রকম সবখানে। স্যালারিও ওভারঅল সেম। তাই যে যেখানে কাজে ঢোকে সেখানেই প্রায় সারাটাজীবন পার করে দেয়।”

“তুমি এটা জানলে কিভাবে?”

“বই পড়ে”

“তুমি বই পড়?”

“হ্যা আন্টি। আমিতো বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র করি।”

“তাই?

“হ্যা।”

“তোমার পড়ালেখায় সমস্যা হয় না?”

“না। আমি বরবরই ক্লাশে ফাস্ট।”

“বাঃ সুন্দর।”

“আচ্ছা তোমার মা কোথায় জব করেন?

“মা? মা একটি স্কুলে পড়ান”

“সুন্দর।”

“সুন্দর বললেন?”

“কেন সুন্দর বলবো না কেন?

“পৃথিবীতে পড়ানোর কাজটা সবচেয়ে বাজে। কাউকে বোঝানো? সবচেয়ে বিরক্তিকর। এই কাজ যারা ভালমত করেন তাদের অনেকে মাথা ঠিক রাখতে পারেন না। আমার মাও পারেন না। বাড়িতে সারাক্ষণ আমাদের সাথে মেজাজ দেখাতে থাকেন”

“বলোকি?”

“হ্যা”

“তাই মা সম্পর্কে কেউ এভাবে বলে নাকি? পাগল ছেলে।”

“না না আন্টি আমি কিন্তু মায়ের বদনাম করিনি। আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”

আমি তর্কে গেলাম না। তাকে ভুল প্রমানিত করা তো আমার উদ্দেশ্য না। আমার উদ্দেশ্য ভিন্ন। আমি মালিহাকে ডাকলাম। তাকে বললাম, তুমি কথা বল। এই যে মালিহাকে আমি ডেকে দিলাম, কথা বলার জন্য, এই কাজটা যে আমি করতে পারি সম্ভবত: পান্থ চিন্তাও করেনি। ডেকে দেবার পর ওরা এক সংগে অনেকক্ষণ কথা বলল। আমি ঘরের টুকি টাকি কাজ করতে থাকলাম। শুধু এক ফাঁকে এসে বলে গেলাম, পান্থ তুমি যাবার আগে আমাকে বলে যেও। তোমার সাথে আমার কথা শেষ হয়নি।

একজন মা-১৫

একথা বলার কিছুক্ষণ পরই মালিহা এসে বলল, মা উনি চলে যাবেন।

এবার আর মালিহাকে বলা লাগেনি ‘তুমি যাও’। ও নিজ থেকেই এই প্রাইভেসিটুকু তৈরী করলো আমার জন্য। পিছনপিছন আসছিল, কিন্তু আমি ড্রইংরুমে ঢুকতেই সে তার নিজের রুমে চলে গেল।

আমি বললাম, “দ্যাখো পান্থ, স্কুলে আমরা মায়েরা বয়স কমিয়ে দেই। বিষয় তা নয়, তোমার প্রকৃত জন্ম তারিখটা বল।”

পান্থ তার প্রকৃত জন্মতারিখটা বলল।

আমি বললাম, ওয়েল, তোমার বয়স তাহলে সিক্সটিন প্লাস। তাহলে মালিহা তোমার ৩ বছরের ছোট। আমি যেটা বলতে চাইছি তাহলো, স্কুলে তোমরা বিষয়টা নিয়ে ওপেন হবে না। আর কখনো বাইরে গিয়ে ঘোরাঘুরি, গল্প, বন্ধুদের বাসায় পার্টি, এসব প্লান করার আগে মনে রাখবে এটা অ্যালাউড না। আমি কোনভাবেই মালিহাকে ঘরের বাইরে অ্যালাউ করবো না। নাম্বার ২, স্কুল থেকে বাড়ি ফেরবার সময় কখনো ওর পিছু নেবে না। এই পাড়ার ছেলেরা ভাল না। তারা জেলাস ফিল করতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের সাথে তুমি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। বিষয়টা জানাজানি হবে। বয়োবৃদ্ধ সামাজিক মানুষেরা সেটাকে সহজভাবে নেবেন না। নাম্বার ৩, তোমার কথা বলতে হলে কথা বলবে মোবাইলে। নেহাত যদি মুখোমুখি দেখা করার দরকার হয়, তুমি সরাসরি আমদের বাড়িতে চলে আসবে। সেটাও সপ্তাহে একআধবার, তার বেশী না”

পান্থ বলল, আন্টি আচ্ছা।

“আচ্ছা না। এগুলো তোমাকে মনে রাখতে হবে। তোমাদের অ্যাকসেসেটা কিন্তু কন্ডিশনাল। রাইট?”
“আমার মনে থাকবে।”
“লেখাপড়াটা ঠিক রাখবে।”
“রাখবো।”
“দ্যাখো, আমার মেয়ে কিন্তু তোমার থেকে ৩ বছরের ছোট। তুমি ওর তিন বছরের বড়। ও কিন্তু অনেক বোকাসোকা। অনেককিছু বোঝে না। ওকে কিন্তু সহজে বিভ্রান্তও করা যায়। তোমাকে কিন্তু অনেক দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ”

“আমি খেয়াল রাখবো।”

“ও যদি কখনো ভুল করে তুমি কিন্তু ভুল করনা।”
“করবো না”
“কখনো যদি মনে হয় ও তোমার জন্য পারফেক্ট ম্যাচ না, তুমি কিন্তু কান্ডজ্ঞানহীনের পরিচয় দিও না”
“আন্টি বলেন কি? আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না”
“না না। আমি খারাপ দিকটা ভেবে বলছি। বাচামরার বিষয়টা তো অনেক পরের”
“আপনি প্লিজ আমাকে লজ্জা দেবেন না। আমি ওকে ছাড়া আমার জীবন চিন্তাও করি না।”
আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, “আচ্ছা একটা কথা।
“বলুন”
“মালিহা বলেছে, তুমি ওকে বলেছিলে যে ওকে না পেলে তুমি সুইসাইড করবে। কথাটা কি ঠিক?”
“হ্যা বলেছিলাম। আই মিন দ্যাট রিয়েলি। আন্টি আমি এখনো বলছি। ওকে ছাড়া আমি আমার জীবনটা জাস্ট কল্পনাই করতে পারি না….”
“ভাল।”
“কিন্তু আমার একটা কথা আছে।”
“বল”
“বিষয়টা নিয়ে আপনি আমার আম্মুর সাথে আলাপ করবেন না।”
“কেন?”
“আমাদের বাড়িতে এ নিয়ে অশান্তি হবে।:
“কিন্তু তোমার আম্মু যদি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করেন, আমিতো কোন মিথ্যা কথা বলতে পারবো না। তাইনা?”

পান্থ চিন্তায় পড়ে গেল। ড্রইং রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে সে স্কুল ব্যাগ কাধে নিতে নিতে বলল, “আম্মু আপনাকে কখনো কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। যদি কখনো জিজ্ঞাসা করেন আপনি যা ভাল বুঝবেন বলে দেবেনে। তবে আমার মাকে আমি যতটুকু চিনি, তিনি আপনাকে কখনো কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না ”

“না করলেই ভাল।”
“আচ্ছা আন্টি আমি আসি”
“এস।”

লিফট নয়, পান্থ সিড়ি দিয়ে নামতে শুরু করলো।

পান্থকে বিদায় জানিয়ে আমি কিচেনের জানালার কাছে গেলাম। উদ্দেশ্য ছিল, পান্থর হাটাটা দেখা। সিড়ি ভেঙে ও যখন নামে, ওর পা ফেলাটা একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছিল আমার। বাইরে তাকাতেই চোখ চলে গেল গেটের সামনে।

দেখলাম পান্থ সাইকেলে উঠছে। হাটাটা দেখা হলো না। সাইকেলে উঠে সে মালিহার ঘরের জানালার দিকে তাকালো। অনেকক্ষণ দাড়িয়ে ইশারায় কি যেন বলল, আমি বুঝলাম না। কিন্তু চুড়ান্ত বিদায় নেওয়ার সময় যেটা করলো সেটা বুঝলাম। ওর হয়তো ধারণাই নেই যে, কেউ ওকে ওপর থেকে দেখতে পারে। কিম্বা আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো এসব পরোয়াই করে না- কেউ তাকে অবজার্ভ করছে কি করছে না। কিন্তু এই ছেলেটা তো আর দশটা ছেলের মত না। তাছাড়া, এইমাত্র যাকে সতর্ক করা হলো, তার কাছ থেকে এটা আশা করা যায়?

পান্থ চলে গেলে মালিহার কাছে গেলাম। দেখলাম, আমার মেয়ের মুখ ছোপছোপ লাল। আমি অবাক হলাম। কিন্তু পরমুহুর্তেই কে যেন ভেতর থেকে আমাকে বলল, অবাক হচ্ছো কেন টুম্পা? কেন লাল হবে সেটা তুমি জানো না? আমার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে এল। আমাকে দেখেই মেয়ে বলল, কি মা?

আমি বললাম, কিচ্ছু না।

একজন মা-১৬

আমার কি বলা উচিত আমি যা বুঝলাম? বা যা অনুমান করলাম? কতটা ওপেন হওয়া যেতে পারে ঐটুকু মেয়ের সাথে? আমি কি বলতে পারি যে, মা, এই একটু আগে তুমি বেশখানিকটা শিহরিত হয়েছো। সেই শিহরণ ছড়িয়ে পড়েছে তোমার শরীরে। ফলে তোমার মুখ হয়েছে রক্তবর্ণ। আমি কি বলতে পারি এসব? এভাবে যদি চলতে থাকে তাহলে তার গন্তব্য শেষপর্যন্ত কোথায় হবে? ও যখন ফোনে কথা বলবে তখনও তো এরকমই হবে। তখন? কিন্তু এটাতো এখন আটকানোও যাবে না। কি করবো আমি?

“কি হলো মা? কথা বলছো না যে!”

“কি বলবো?”

“তুমি হঠাৎ চুপ হয়ে গেলে?”

“কেন? আমি কি তোমার সাথে কথা বলছিলাম? আমি তোমার ঘরে এলাম। তুমি জিজ্ঞাসা করলে, কি মা? আমি বললাম, কিচ্ছু না”

“না, মানে, তোমার মুড অফ দেখছিতো তাই।”

“আমার মুড অফ না। মুড ঠিক আছে।”

“মুড ঠিক থাকলে মুখটা গোমড়া করে আছো কেন?”

“গোমড়া করে আছি কে বলল?”

“গোমড়া করে নেই?”

“দেখো মালিহা কথাবাত্রা ঠিক করে বল। ভুলে যেও না তুমি তোমার মায়ের সাথে কথা বলছো”

“আশ্চর্য! আমি তো জানি আমি কার সাথে কথা বলছি। তুমি আমার মা। আমি জানি না?

“জানলে সেই ভাবে বিহেভ কর।”

“তুমি আমার সাথে এরকম করছো কেন?”

“আমি তোমার সাথে কিরকম করছি?

“কিরকম করছো না?

“না কিরকম করছি না। ইনফ্যাক্ট কিছুই করছি না। তুমি ভুল ভাবছো।”

“আমি ভুল ভাবছি না”

“হ্যা তুমি ভুল ভাবছো।”

“ভুল ভাবছি?”

“হ্যা তুমি ভুল ভাবছো মালিহা। তুমি কল্পনার জগতে বিচরণ করছো। কল্পনার জগতে বিচরণ করার কারণে সবকিছু রঙিন মনে হচ্ছে তোমার কাছে। জাস্ট এই কারণে আমার কথাবাত্রা তোমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। আর কিছু না।”

মেয়ে চুপ করে গেল।

দেখুন, মানুষতো আমি। ফেরেশতা তো নই। এটাই ছিল আমার প্রথম এবং একমাত্র ভুল। আমি যে একটা কিছু তার কাছে গোপন করলাম। সেটা সে বুঝলো। কিন্তু সেটা যে কি তাতো সে বুঝতে পারছে না আর আমিও লজ্জ্বায় তাকে সে কথা বলতে পারছি না। ১৩ বছরের মেয়ের সাথে আমি যৌন উত্তেজনার কারণ, তার পরিণতি, অবয়ব, হরমোনাল ব্যাপারস্যাপার, এসব নিয়ে কথা বলবো? কি করে?

আমার সংস্কার, আমার সংস্কৃতি, আমার বোধ, আমার অতিতের সবকিছু বাধা হয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। সানন্দা আর ননফিকশন পড়া বিদ্যা দিয়ে আমি নিজেকে কোনভাবেই উদ্ধার করতে পারলাম না। কিছুতেই তার সামনে ওপেন হতে পারলাম না। এই যে প্রকৃত সত্যটা তার কাছে এড়িয়ে গেলাম, এবং তার সাথে অহেতুক তর্ক করলাম, তাতে সে ধরেই নিলো তার মা তার কাছে সবসময় সবকিছু এড়িয়ে যায়। তার মায়ের মত মানুষের পক্ষেও গোয়ার্তুমি করা সম্ভব। এবং সে করেও। ফলে পরের বার যেদিন এরকম একটি পরিস্থিতি তৈরী হলো, সেদিন সেও যেমন আর সে চুপ থাকলো না আমিও তেমনি সহ্য করতে পারলাম না। আমি একটা বললাম সে একটা বলল।  সে একটা বলল আমি একটা বললাম। উত্তপ্ত কথার মধ্যে দিয়ে, সহজ একটা বিষয় ক্রমশ ভয়াবহরকম জটিল হয়ে গেল। এক পর্যায়ে আমি ধৈর্য হারালাম ও টেমপার লুজ করে ফেললাম। আমার সাথে সাথে মেয়েও। সে আমাকে অবাক করে দিয়ে আমাকে ছাড়িয়ে গেল।

দুপুরের ঝাঝালো রোদ্দুরের মধ্যেও আমাদের গোটা ফ্লাটটা অন্ধকার হয়ে গেল। নিজেও কিছু মুখে দিতে পারলাম না। ছোট মেয়েটাকেও ভালমত খাওয়াতে পারলাম না। খাওয়াতে গিয়ে যে মানুষ আমি কখনো ধৈর্যচ্যুত হই না সেই মানুষ সামান্য কারণে মৃদুলার পিঠে একটা চড় দিলাম। সে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়লো।

রবির কথা মনে পড়লো, ও বলেছিল, প্রকৃত সমস্যায় বইয়ের বিদ্যা কোন কাজে লাগবে না। একটা মানুষ অ্যাকাডেমিক পড়াশুনার বাইরে বইপত্র তেমন পড়েনি। কিন্তু মাঝে মধ্যে খুব দুরদর্শী মানুষের মত কথা বলে। আমি রবিকে একটা কল দিলাম, রবি অবাক হয়ে বলল, কি ব্যাপার টুম্পা? আমাকে ফোন দিলে? কোন সমস্যা?

একজন মা-১৭

“এমনভাবে বললে যেন সমস্যা ছাড়া আমি কখনো ফোন দেই না!”

“না না তা নয়। আমি সেটা বলিনি।”

“বললে এই মাত্র আবার বলছো ‘আমি সেটা বলিনি?’..আচ্ছা যাগগে। তোমরা বাপবেটি মিলে আমার জীবনটাকে তো হেল করে দিয়েছো। এখন একটা কাজ কর, আমাকে আমার বাপের বাড়িতে রেখে আসো।”

“পরে কথা বলি আমরা”

“পরে কথা বলবো মানে?…তুমি কি বলতে চাইছো?”

“প্লিজ টুম্পা, রাগ কমাও। তুমি তো ঠান্ডা মাথার মানুষ। মাথা গরম করছো কেন? এই কারণে বলি সকাল সকাল ঘুমাও। তোমার ঘুম কম হচ্ছে। ঘুম কম হলে পেট গরম হয়। পেট গরম হলে মাথাও গরম হয়।”

“জ্ঞান দিও না। তুমি আমাকে আজই আমার বাবার কাছে রেখে আসবে। আমি তোমার সংসার করবো না।”

“আচ্ছা রেখে আসবো। তুমি কিন্তু এখনো আমার অপরাধ বলনি। মালিহা কিছু করেছে?”

এই প্রশ্নে আমি হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। তারপর কাঁদতেই থাকলাম। একটা কষ্ট আমার বুকের গভীর থেকে ঢেউয়ের মত উঠে এল। তারপর গলার কাছে দলা পাকিয়ে পড়ে রইল। কিছু কিছু ক্লাসিক সিনেমা দেখার সময় আমি এইরকম ব্যথা অনুভব করেছি। বস্তুত এ এক অন্যরকম ব্যাথা যখন সন্তান তার মাকে গালমন্দ করে। কি করে সেটা সুস্থতা হয়? কিন্তু, কিন্তু আমিতো তার হেলদি আপব্রিংইংএর জন্য একটা ইমম্যাচিউরড রিলেশনশিপকে অ্যাপ্রুভ করেছিলাম। চেয়েছিলাম সে সুন্দরভাবে বেড়ে উঠুক। তার জীবনের প্রতিটি ধাপে সে যেন কোন কিছু মিস না করে। একটাই জীবন মানুষের, প্রথাগত কোন ব্যাপার যেন তার মনের প্রাপ্তির পথে বাধ না হয়। সে তার মূল্যায়ণ করবে না? প্রতিদান না দিক, এমন হবে কেন তার পরিণাম? রবি মোবাইলে বার বার বলতে লাগলো, “যাঃ পাগল। রাগ করছো কেন? বল আমাকে কি হয়েছে?” কিন্তু একবারও বলল না, “আমি কি আসবো?” জানতাম সে বলবে না। তখন কান্না থামিয়ে আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারলাম, “আচ্ছা ঠিক আছে হ্যা। পরে কথ বলবো। রাখছি এখন।” বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে থাকলাম। কিন্তু রবি ব্যতিক্রমভাবে অফিস থেকে সেদিন আগে আগে চলে এল। কোন কথাবাত্রা না, এসেই সে সোজা তার মেয়ের ঘরে চলে গেল। খাটের যেখানে আমি বসে সেখান থেকে ওর বেড দেখা যায়। শুয়ে ছিল মালিহা পাতলা চাদরের নিচে, ওর বাবা একটানে কাথা সরিয়ে ফেলল। মেয়ে সাথে সাথে ধড় ফড় করে উঠে বসলো বিছানার ওপর। রবি বলল, “কি হয়েছে মালিহা?”

“কই কিছু না তো”

“কিছুতো নিশ্চই, কি সেটা বল। আমি তোমার মুখে শুনতে চাই। তোমার মায়ের চোখের জলের কারণ হলে কেন?”

“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“চড় দিয়ে তোমার দাত ফেলে দেবো। কিচ্ছু বুঝতে পারছো না তাইনা?”

“কি আশ্চর্য আমাকে চড় দেবে কেন?

“আর একটা কথা বললে এক্ষুনি দেবো”

“দাও।”

বলেই মেয়ে এগিয়ে এল ওর বাবার দিকে আর ঠিক সেই সময় আমি এগিয়ে গিয়ে ওর বাবাকে ধরলাম। পুরুষ মানুষের আর কিছু থাক না থাক গায়ের জোরটা মেয়েদের থেকে একটু বেশীই থাকে। প্রচন্ড শক্তি ক্ষয় হয়ে গেল তাকে আটকাতে। আমি পারলাম। কিন্তু চিল্লাপাল্লাতে ততক্ষণে ছোট মেয়েটা ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। সে ভয় পেয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলো। এই রকম পরিস্থিতি তো সে কখনো দেখেনি। আমি রবিকে কোনরকম বুঝিয়ে শুনিয়ে ঘরে আনলাম। কিন্তু আমরা বের হবার সাথে সাথেই মেয়ে দরজা আটকে দিলো তার ঘরের। “আমরা যত বলি মালিহা দরজা খোলো, মালিহা দরজা খোলো। মালিহা আম্মু শোন। এত জিদ করতে নেই।”

সে দরজা খোলেনা। কোন সাড়া শব্দ নেই। আমাদের একটা ডাকেরও উত্তর নেয় না।

আমি অস্থির হয়ে গেলাম। ওর বাবা হলো আমার থেকে বেশী। একি! সাজানো সুন্দর সংসার আমার। একটুকরো স্বর্গ কপালবশত: প্রকান্ড নরকে পরিণত হতে যাচ্ছে। আশপাশের মানুষদের আমাদের প্রতি আলাদারকম রেসপেক্ট। কারণ আর কিছু না। আমাদের সম্পর্ক। রবির আর আমার যে ঝগড়া হয় না। তা নয়। ঝগড়া ফ্যাসাদ মতের অমিল কোন্ সংসারে হয় না? কিন্তু বিশ্বাস করুণ আমাদেরকে আশপাশের কেউ উচ্চস্বরে কখনো কথা বলতে দেখেনি। রেসপেক্ট টা এই কারণে। কিন্তু এখন জানবে এই ফ্লাটটা আর দশটা ফ্লাটের মত। বার বার ডাকার পরও যখন মালিহা দরজা খুলল না, রবি নয়, আমিই ধাক্কা দিয়ে প্লাস্টিকের দরজার ছিটকিনি ছুটিয়ে ফেললাম। ঘরে ঢুকে দেখি সে বাথরুমে। দরজা বন্ধ সেটারও। বাথরুমে কেন ও? ওখানে কি করছে? আমার সমস্ত শরীর দিয়ে একটা শিহরণ নেমে গেল। আমি রবির দিকে তাকালাম। রবি আমার দিকে।

https://middleearthnj.wordpress.com/

2011/04/04/typical-vs-abnormal-

teen-behavior/

Adolescence is a time of change. The changes can be so dramatic that it leaves parents

wondering if what they are seeing is just typical teen behavior or cause for concern.

The American Academy of Child and Adolescent Psychiatry (AACAP) reports that the

teenage years are marked by trying on independence through experimentation. Typical

teen behavior includes many things that seem strange to parents. Dyed hair, odd piercings,

strange music and even new friends are all part of growing up for some teens. And some

teenagers also choose this period in life as a time to experiment with alcohol and

drugs, and sometimes sex. Also, the hormonal changes in a teenager’s body can

produce moodiness. A teen’s brain is still developing, so some parts of the brain that house

logical thinking and memory are not fully formed and can lead to lapses of

judgment and sometimes risky behavior. Additionally, a desire for independence and

becoming one’s own person can lead teenagers to distance themselves from their

families.

Typical Teen Behaviors

It is important to understand that some teenage behaviors that seem bizarre to parents

are a normal part of teen life. Here are some normal teenage behaviors:

Changing one’s appearance. Styles come and go, and keeping up with trends is

important for teenagers. Dyed hair and a body piercing or two is stylish. Boys may

experiment with goatees, growing long hair, or shaving their head. For teenage girls,

appearance becomes very important. They want to be attractive and trendy. They

become very aware of how they differ from their peers and will try on different

identities as they try to fit in.

Some withdrawal from family life. Typical teen behavior includes a focus on one’s

friends and a desire to be independent of the family, to be one’s “own person.” Your

teen will not talk to you as often as he or she used to, and he or she may pull away, or

not want to be seen in public with you. Teens seem to have different opinions than

their parents and their friends have a more important role in the decisions they make.

Increased arguments. Your teen will quarrel with you more. There will be

arguments and defiance. However, with typical teen behavior, these arguments are

not constant, nor do they become violent or result in long-standing sullenness

or resentment. Typical teen behavior will include accusations that you do not love

him or her, that you are unfair, that all his or her friends get to do something, or

that he or she hates you. They will also try to test limits, such as staying out a

half hour past curfew.

Emotional ups and downs. Typical teenage behavior comes with emotional ups

and downs, as well as intervals of moodiness. Teens feel things intensely.

Your teen may complain of having no friends one week, and then go out on the

weekend with friends and be fine for a couple of weeks. The teen years are filled with

uncertainty and magnified emotional responses. One minute your sweet child is

begging you to come on the class trip or to lie down with her while she falls

asleep. Then, seemingly overnight, she starts treating you like dirt, slamming doors,

discounting everything you say and snickering at your suggestions.

Ways to Deal with Typical Teen Behavior

It is easy to feel hurt by a teen’s treatment and rejection. It is also easy to respond by

returning the rejection. But try to remember that the roller coaster ride they put you on

is also the one that they’re feeling internally. Kids can wear weird clothes, pierce

their lips, act rudely and still be decent kids. The best response to typical teen behavior

is to stay calm, which provides teens the stability they need. However, staying calm

does not mean that you allow all of their behavior. It’s important to establish clear

rules and enforce them.

One thing to avoid: Parents tend to trivialize the importance of things in teenagers’

lives, but that makes kids feel misunderstood, and eventually they will stop telling

you anything. When your kids talk to you, don’t offer advice, disparage their

friends or try to minimize their worries. Just listen and sympathize. Read our

previous blog “Effectively Communicating with Teens” to learn ways to

improve your relationship with you teen.

Abnormal Teen Behavior

Some teenager behavior is actually a warning sign for more serious problems and

not just a ‘typical teenager,’ such as:

Stealing.

Being physically abusive to others or destructive in the house.

Being verbally abusive, intimidating or threatening.

Anxiety or sadness that never seems to go away.

Obsessing about weight and/or dramatic changes in eating habits.

Pattern of never going out with friends.

Hanging out with a dangerous crowd.

Coming home drunk or high.

Staying out all night.

Getting arrested.

Constant need to argue, even over small things.

Openly defiant and/or refusing to follow rules.

Passing the blame for everything – never taking any responsibility for their actions.

If you see these behaviors in your teen, it’s time to investigate possible problems

and/or get professional help.

resources/publications/normal-teenage-behaviour-vs-early-

warning-signs-of-mental-illness/ (Normal vs Abnormal in detail)

http://www.dailymail.co.uk/news/article-2440182/Children-start-dating-young-likely-behavioural-problems-wait-love-says-study.html ( Teen Love and Sex)

http://www.today.com/parents/young-love-parents-dealing-teen-romance-2D80555520

একজন মা- ১৮

সংসার জীবনটাকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে একটা বহতা নদী দিয়ে। স্রোতেরে ধরণ যেমন চরিত্র নির্ধারণ করে নদীর, নদী তেমনি প্রভাবিত করে তার সংলগ্ন মানুষ ও প্রকৃতিকে। সংসারজীবনের বিষয়টাও ঠিক সেরকম। এটি প্রভাবিত হয় এর অভ্যন্তরের ঘটনাবলি দিয়ে। অভ্যন্তরের ঘটনাবলী নির্ধারক হয়ে ওঠে সাংসারিক সুখ ও শান্তির। জীবন বিষিয়ে তুলবে নাকি তুলবে না সেটিই হলো মূল বিষয়। আপনি শান্তিতে থাকবেন নাকি অশান্তিতে।

নদী প্রবলপরাক্রম স্রোতস্বীণী হলে কুল ভেঙে গুড়িয়ে দিতে পারে। তছনছ করে ফেলতে পারে বিস্তির্ন জনপদ। আপনার সংসার জীবনের ঘটনাবলীও যদি তেমন পরাক্রমশালী হয়, আপনার জীবনও ভেঙেচুরে চুরমার করে আপনাকে উদ্বাস্তু করে তুলতে পারে। সেই সাথে আপনাকে কেন্দ্র করে অন্যদের জীবনও বিষিয়ে যেতে পারে।

আবার ধরুণ জীবনটাকে একটা জার্নির সাথে তুলনা করা যেতে পারে। একটা লং ড্রাইভ। ধরুণ আপনি কোথাও যাচ্ছেন, রওনা হয়েছেন বাড়ি থেকে, আপনি পৌছতেও পারেন, আবার নাও পারেন। আপনি কিন্তু নিশ্চিত নন আপনি পৌছুবেনই। যদি আপনার কোন বিপদআপদ না হয় আপনি পৌছে যাবেন, হলে অসুবিধায় পড়লেন। পৌছুতে পারলেন না। সংসার জীবন হলো অনিশ্চয়তার মায়াজাল।

রবি বলছিলো আমাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে। আমি তো ঠান্ডা মাথারই মানুষ। হ্যা এটা ঠিক, আমি মাথাটা একটু গরম করে ফেলেছি। সত্য। কিন্তু আপনি কতক্ষণ মাথা ঠিক রাখতে পারবেন?

আপনি কতক্ষণ মাথা ঠিক রাখতে পারবেন সেটা কিন্তু একটা বিশাল ফ্যাক্টর।

বাদ দিন আমার কথা। রবি কি করলো? অফিস থেকে ফিরে সে তো আমার সাথে কোন কথাই বলেনি। কোন আলোচনা বা পরামর্শই করেনি। সোজা এসেছে, মেয়ের ঘরে ঢুকেছে। তারপর শুয়ে থাকা মেয়েটার শরীর থেকে একটানে চাদর নামিয়ে ফেলেছে। সে তার গায়ে হাত তুলতে পর্যন্ত গেছে। বলেছে চড় দেবে। কবে সে চড় দিয়েছে মেয়ের গালে?

যদি সে চড় কোনদিন নাই দিয়ে থাকে, তাহলে আজ সে চড় দিতে যাবে কেন? যখন মেয়েটি একটি জটিল সময় পার করছে? বিশেষত: যার শরীর ও মন পাল্টাচ্ছে সেই সময় সে কেন তাকে গায়ে হাত তোলার কথা বলবে? বাবা হিসেবে আমি বলছি না তার শাসনের অধিকার নেই। অফকোর্স আছে। কিন্তু শাসন বলতে কি শুধু গায়ে হাত তোলা? শাসন বলতে কি শুধু ভয় দেখানো? যে মেয়ে কোন দিন চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি আজ সে চোখ পাকিয়ে কথা বলছে। জামা কিনতে নিয়ে গেলে যে মেয়ে বলেছে ‘তুমি একটা পছন্দ করে দাও’ আজ সে বলছে ‘এই কালারটা ভাল মা, ঐ প্রিন্টটা খ্যাতখ্যাত’ তার মানে? তার মানে মোদ্দা কথা এই যে, তার পছন্দ অপছন্দ তৈরী হচ্ছে। সে তার ইনডিভিজুয়ালিটিটাকে সেট করছে। এই রকম সময় মাথা ঠান্ডা রাখার দায়িত্ব কি শুধু মায়ের?

তারপরও আমি স্বীকার করবো ভুলটা আদতে আমারই হয়েছে। আমার বোঝা উচিত ছিল, আমি যে বেটামানুষটার ঘর করি সে আসলে আমার থেকে অনেক বেশী ইল টেম্পারড। তার সহ্য ক্ষমতা, তার রিঅ্যাক্ট করার ধরণ, তার বুদ্ধিবৃত্তিক দৌড়, সবকিছু অন্যরকম। জাস্ট এটা আমার মাথায় রাখা উচিত ছিল। আর কিছু না হোক একটা ব্যাপারে আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। এই লোকটার সামনে ভবিষ্যতে কান্নাকাটিও করা যাবেন। কাঁদতে হলে অন্ধকারে দেয়ালের সামনে অথবা বাথরুমের দরজার আঁড়ালে গিয়ে কাঁদতে হবে। অথবা আমার বুকের কষ্ট আমার বুকেই পাথর চাপা দিতে হবে। কারণ আমি যে মানুষটা সামনে কাঁদবো সে তার উপযুক্ত নয়। আমি যে তার সামনে হালকা হওয়ার জন্য একটু চোখের জল  ফেলেছি, ফোনে কথা বলার সময়, তার ফল হয়েছে উল্টো। সে সেটা সহ্য করতে পারেনি। কতখানি বিপর্যস্ত হয়েছে সে যে, অফিস ফেলে ছুটে এসেছে। প্রথমে আমার ভালই লাগছিল, কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। কতটুকু তাকে বলবো আর কতটুকু তাকে বলবো না। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করার পরও যখন মেয়ের কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। বাথরুমের দরজাটাও ভেঙে আমি ফেললাম।

কিন্তু, দেখুন, একটা কথা মনে রাখবেন। সব দরজা কিন্তু সবসময় প্লাস্টিকের হবে না। কিছু কিছু বাড়ির কিছু কিছু দরজা হবে মেহগনি, কাঠাল অথবা শিরিষ কাঠের। সেসব দরজা আপনি চাইলেও নাটকসিনেমার মত সহজে ভেঙে ফেলতে পারবেন না। দরজা ভাঙার কাজটা বাস্তব জীবনে আদতেই অনেক কঠিন।

বাথরুমের দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে দেখি মেয়ের হাতে স্টেনলেস স্টিলের নতুন ব্লেড, ফ্লোরে রক্ত। এক কর্নারে দেয়ালের সাথে মাথা ঠেকিয়ে পড়ে আছে সে।

একজন মা- ১৯

বাথরুমের মধ্যে রবিই প্রথম ঢুকলো। সে ঢুকেই মালিহার হাত থেকে ব্লেডটা নিয়ে নিল। তারপর মেয়েকে পাজা কোলে করে তুলতে গেল। প্রথম চান্সে পারলো না। মেয়ে তাকে ঝাটকা দিয়ে সরিয়ে দিলো। কিন্তু তার সাথে জোর খাটিয়ে বেশীক্ষণতো টিকে থাকা সম্ভব না। রবি ওকে জোর করেই পরেরবার কোলে উঠিয়ে ওর ঘরের খাটের ওপর নিয়ে এল। আমাকে বলল, টুম্পা ঘরে তুলা আছে? থাকলে একটু তুলা আনতো।

আমি হাতের কাছে কিছুই পেলাম না। প্রয়োজনের মুহুর্তে হাতের কাছে কিছু পাওয়া যায় না। তাছাড়া, ভেবে দেখলাম, তেমন করে তো তুলার প্রয়োজন কখনো পড়েনি। একটা স্যাভলনের শিশি ছিল রবির সেভ হওয়ার সরঞ্জামের কাছে, আমি সেটি হাতে করে ফিরলাম।  পাশাপাশি, সেলাইকাজ সেরে নতুন কাপড়ের টুকরো জমা করে রাখতাম যেখানে সেখান থেকে সাথে একটুকরো পরিস্কার কাপড়। রবি টুকরো কাপড়টুকু দিয়ে মেয়ের ফাস্ট এইডের কাজ শুরু করতে গেলে, মেয়ে তার হাত ঝাট করে সরিয়ে দিয়ে বলল, তোমরা যাও। আমি আর বাঁচতে চাই না।

বাঁচতে চাও না মানে? না বাঁচার মত কি হয়েছে?

অনেক কিছু হয়েছে।

কি সেটা বল।

ও তোমাদের বলে লাভ নেই।

আমাদের বলে লাভ নেই একথা তুমি বলছো?

হ্যা বলছি।

বেশ ভাল। তো সে কথা গুলি তুমি কাকে বলবে?

কাউকে বলবো না।

তাহলে সমাধান হবে কিভাবে?

মালিহা চুপ।

রবি বলল, দ্যাখো মামনি, আমার কথা বাদ দাও। আমি সারাদিন অফিসে থাকি আমার জীবনটা বাইরের। আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে গেছি। মানছি যে সেটা আমার অপরাধ হয়েছে। কিন্তু তোমার মা। সে বেচারার জীবন এই চারদেয়ালের মধ্যে আটকা। তোমাদের নিয়েই তিনি কাটিয়ে দেন। তার সাথে তুমি এভাবে বিহেভ করতে পারোনা। পারো কি?

আমি তার সাথে কোন খারাপ বিহেভ করিনি। বরং সেই আমাকে-

সেই আমাকে কি? থামলে কেন বল।

দাড়াও মালিহা, আমি বললাম, আমার অপরাধটা শোন তুমি। স্কুল থেকে ফিরেছে। আমি মৃদুলাকে নিয়ে ব্যস্ত। বলল, আমার ক্ষিদে পেয়েছে। আমি বললাম, যা তা মুখে দিও না। একবার গোসল করে তারপর ভাত খাও। এখন যদি কিছু মুখে দাও তাহলে খাওয়া নিয়ে খুব ঝামেলা করবে তুমি। সুতরাং যাও আগে গোসল কর। গোসল করে এসো আমি ভাত দিচ্ছি। বেশ ভাল কথা। তুমিতো জানো মৃদুলাকে খাওয়াতে গেলে ও কেমন করে। ওকে খাওয়াচ্ছি। আমাকে পেছন থেকে এসে জাপটে ধরেছে। আমি বললাম, মালিহা। তোমাকে আমি বলেছি না। গায়ে হাত দেওয়া। জড়িয়ে ধরা আমার পছন্দ না। জাস্ট এই কথাটা আমি বলেছি। এই হলো আমার অপরাধ। সেটাকে নিয়েই ত্যানা প্যাচাতে প্যাচাতে ….”

রবি আমাকে একবার দেখে নিয়ে মেয়েকে বলল, ছি ছি। এটা কোন কথা হলো? তুমি পাগলামি করছো। আমরা মনে করেছিলাম তুমি বড় হয়েছো কিন্তু এখন দেখছি না, তুমি বড় হওনি। ‍সুতরাং এখন থেকে কোন কিছু বলার আগে আমরা দশবার ভাববো। চড় মারতে চাওয়াতো বাড়ির কাছে। আমি আর কখনো তোমার সাথে উচ্চস্বরেই কথা বলবো না। কিন্তু ছি ছি ছি তুমি এরকম একটা কান্ড করতে পার ভাবতেই পারছি না। ব্লেড দিয়ে তুমি হাতে পোচ দিয়েছো। আর একটু হলেই ভেইনটা কাটা পড়তো। গড। ভাবতেই তো আমার গা শিউরে উঠছে।

বলতে বলতে রবি মেয়েকে বুকের মধ্যে নিয়ে নিলো। পাশেই দাড়ানো আমি।

মালিহা হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আম্মু আমাকে একটুও ভাল বাসে না। আমাকে একটুও আদর করে না। বাবা এটা আমি বেশ বুঝি।

তোমার আম্মু তোমাকে আদর করে না এটা তোমার কেন মনে হলো?

আমি যখনই তাকে ধরতে যাই সে আমাকে সরিয়ে দেয়।

তাতেই তুমি ধরে নিলে মা তোমাকে ভালবাসেন না?

তো?

ভালবাসা প্রকাশ করার কায়দাটা কি সবার সমান হয় মা? কেউ জড়িয়ে ধরে যেমন ভালবাসা প্রকাশ করে তেমনি কেউকেউতো আবার  একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকেও ভালবাসা প্রকাশ করতে পারে। পারে না?

মেয়ে তার বাবার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

রবি বলল, তোমার মা তোমাকে কত ভাল বাসেন। এই যে একটা ছেলের সাথে তুমি কথা বল ফোনে, সে আমাদের বাড়িতে আসে। তার সাথে কথা বলার জন্য তোমাকে কত সুন্দর একটা সুযোগ দিলেন। কজন মা তার মেয়েকে এই সুযোগ দেবেন?

কেউ দেবেন না।

বিশ্বাস কর দেবেন না?

হ্যা বিশ্বাস করি।

তুমি আর মৃদুলা সারাদিন কত জ্বালাতন কর, কই তোমার মাতো কখনো বিরক্ত হন না। হন কি?

না হন না।

যখনই যা চাইছো সে তার সামর্থের মধ্যে সবটুকু করতে চাইছে। আর কিভাবে ভালবাসবে সে তোমাদের? এরকম একজন নিবেদিত প্রাণ  মানুষটাকে কি না তুমি বলেছো জঘন্য মেয়েমানুষ? এভাবে কেউ বলে? তুমি যদি একটা খারাপ কথা বল, আমরা তোমাকে বলবো না যে, সেটা খারাপ কথা?

অবশ্যই বলবে

তাহলে?

কিন্তু বাবা সারাক্ষণ যদি তুমি খ্যাচখ্যাচ কর, আমি যদি তোমার গায়ে একটু হাত দেই আর তুমি যদি সবসময় দুর দুর কর তোমার কেমন লাগবে?

আমি তোমার কথা বুঝলাম না।

মা আমার সাথে সারাক্ষণ খ্যাচ খ্যাচ করে। জিজ্ঞাসা কর।

এটা কি কথা। খ্যাচ খ্যাচ করবে কেন? তোমার মা তোমাকে বোঝান।

ওটাকে বোঝানো বলে না।

তাহলে তুমি বল কাকে বোঝানো বলে।

আমি কি তোমাদের মত বড় যে বোঝাবো কি করে বোঝাতে হয়। এই যে, মা একটু আগে বলল, ত্যানা প্যাচানো এটা কি ধরনের শব্দ? এই একই কথা যদি আমি বলতাম তাহলে আমি তোমাদের কাছে খারাপ হয়ে যেতাম। আসলে বাবা আমি যা করবো সেটা খারাপ। আর তুমি মা তোমরা যা করবে সেটা ভাল। আমার কোনটাই কিন্তু ভাল হবে না। সেটা আমি বুঝে গেছি।

এই দ্যাখো তুমি কিন্তু আবার ভুল বুঝছো।

আচ্ছা যাক ভুল বুঝছি। বাদ দাও। আমার একটা কথার উত্তর দাওতো। আমি যদি তোমাকে জড়িয়ে ধরি, আদর করতে যাই তুমি কি সারাক্ষণ আমার সাথে দুর দুর করতে পার?

রবি এই স্ট্রেট কথাটায় কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো।

কারণ, সে যদি এই কথাটার ইয়েস নো টাইপের জবাব দিতে যায়, তাহলে আমাকে তার কিছুটা অপরাধি করতে হয় । ওদিকে সে চাইছে না আমি মেয়ের সামনে অপরাধী হই।  আপাতদৃষ্টিতে দেখলে বিষয়টাকে খুব নিরিহটাইপ মনে হবে। কিন্তু ক্রিটিক্যালি বিষয়টা সেরকম নয়। হ্যা, সে অবশ্য, আমাকে কখনো কখনো বলেছে দ্যাখো, সন্তানতো তোমার। একটু যদি জাপটেজুপটে ধরে তাতে তোমার সমস্যা কোথায়।

সমস্যাতো একটা নিশ্চই আছ।  যদি নাই থাকবে তাহলে তো আমি তাকে সেই অ্যাকসেস দিতাম। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। পছন্দ অপছন্দের বিষয়। আমার একটা পছন্দ অপছন্দকে আমার সন্তান সম্মান জানাবে না? বাবামায়ের একান্ত বিষয় যদি সন্তান সম্মান করতে শেখে সেই জীবন সম্পূর্ণ জীবন নয়। সেটি খন্ডিত জীবন। মা হিসেবে সেটি বোঝানো ও মানানোটা আমার কর্ততব্য। আমি সেটাই করতে চেয়েছি। আমি তাকে রবিকে সে কথা বলেছিও। কিন্তু রবি তার জায়গায় অটুট। সেও চায় মালিহা আমাকে জড়িয়ে ধরুক আমার অপছন্দের বাইরেও। এই কারণে মেয়ের সামনে সে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লো।  কিন্তু আমি দেখলাম, পরিস্থিতিটাকে মেয়ে অন্যদিকে নিয়ে ফেলেছে। আসল বক্তব্য আড়ালে চলে যাচ্ছে। তখন তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ভুত বিষয়টাকে মেটানোর জন্য বললাম, মালিহা আমি যত বড় অপরাধী হই না কেন তুমি কি আমাকে বলতে পারো আমি জঘন্য মেয়ে মানুষ? এ ধরণের কথা কি মাকে বলা যায়? তোমাকেতো আর দশজন মানুষের মত তো ট্রিট করা হচ্ছে না। তুমি কেন টিপিক্যাল অ্যাভারেজ মানুষের মত বিহেভ করবে? তোমার তো আন্দাজও নেই তুমি কি বলেছো। যদি থাকতো তাহলে তুমি বলতে না। আসলে আমারই হয়তে কোথাও ভুল আছে। কোন পাপ আছে। তা না হলে এরকম কথা নিজের মেয়ের কাছ থেকে শুনবো কেন?

বলতে বলতে আমি কেঁদে ফেললাম, প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম শক্ত থাকতে। কিন্তু কোথ্থেকে যেন একটা আবেগ চলে এল আমি পারলাম না। আমার হাতপা অবশ হয়ে এল। একটু অভিমাণও হচ্ছিলো। ফলে নিজের শোবার ঘরে চলে এলাম। রবিই বোঝাচ্ছিলো মালিহাকে। অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ বলতে পারবো না। আমি কাঁদছিলাম আর ভাবছিলাম এখন যদি এই হয়, সামনে কি হবে? কিভাবে পরিস্থিতিকে তখন আমি ম্যানেজ করবো? কোন্ ভবিতব্য অপেক্ষা করছে আমার জন্য? কোন বিপদ ধেয়ে আসছে আমার জীবনে?

একসময় আমার মাথায় হাতের স্পর্শশপেয়ে আমি সচকিত হলাম। দেখি রবি দাড়িয়ে আছে। পাশে মালিহা। কাঁদতে কাঁদতে আমার উপর গড়িয়ে পড়লো। “মামনি আমি ভুল করেছি। আমার অন্যায় হয়েছে। আমি তোমার সাথে খুবই খারাপ আচরণ করেছি। আমাকে ক্ষমা কর। জানো কি যে হয় আমার বুঝতে পারি না। রাগে অন্ধকার দেখি। তারপর একসময় দেখি তোমাকে আমি সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দাও।

তখনই আমার সন্দেহ হলো, একটা কিছু হচ্ছে যা আমি ধরতে পারছি না।

একজন মা- ২০

রবি বলল, “তোমার মা তোমাকে কত ভাল বাসেন। ভালবাসাটা তুমি বুঝতে পারছো না। সেটা তোমার ভুল, তোমার মায়ের নয়। এই যে একটা ছেলের সাথে তুমি কথা বল ফোনে, সে আমাদের বাড়িতে আসে। তার সাথে কথা বলার জন্য তোমাকে কত সুন্দর একটা সুযোগ দিয়েছেন তোমার মা। তুমি তার সাথে ঘন্টর পর ঘন্টা কথা বল। হাসো। কত ভাল লাগে তোমার। কজন মা তার মেয়েকে এই সুযোগ দেবেন?”

“কেউ দেবেন না।”

“বিশ্বাস কর দেবেন না?”

“হ্যা বিশ্বাস করি।”

“তুমি আর মৃদুলা সারাদিন কত জ্বালাতন কর, কই তোমার মাতো কখনো বিরক্ত হন না। হন কি?

“না হন না।”

“যখনই যা চাইছো তিনি তার সামর্থের মধ্যে সবটুকু করতে চাইছেন। আর কিভাবে ভালবাসবেন তিনি তোমাদের? এরকম নিবেদিত প্রাণ মানুষটাকে কি না তুমি বলেছো জঘন্য মেয়েমানুষ? এভাবে কেউ বলে? তুমি যদি একটা খারাপ কথা বল, আমরা তোমাকে বলবো না যে, সেটা খারাপ কথা?”

“অবশ্যই বলবে”

“তাহলে?”

“কিন্তু বাবা সারাক্ষণ কেউ যদি খ্যাচখ্যাচ করে, ধর, তুমি যদি কা কারো গায়ে একটু হাত দাও আর সে যদি তোমাকে সবসময় দুর দুর করে তাড়িয়ে দেয়। তোমার কেমন লাগবে?”

“আমি তোমার কথা বুঝলাম না।”

“মা আমার সাথে সারাক্ষণ খ্যাচ খ্যাচ করে। জিজ্ঞাসা কর।”

“এটা কি কথা। খ্যাচ খ্যাচ করবে কেন? তোমার মা তোমাকে বোঝান।”

“ওটাকে বোঝানো বলে না।”

“তাহলে তুমি বল কাকে বোঝানো বলে।”

“আমি কি তোমাদের মত বড় যে বোঝাবো কি করে বোঝাতে হয়। এই যে, মা একটু আগে বলল, ত্যানা প্যাচানো এটা কি ধরনের শব্দ? এই একই কথা যদি আমি বলতাম তাহলে আমি তোমাদের কাছে খারাপ হয়ে যেতাম। আসলে বাবা আমি যা করবো সেটা খারাপ। আর তুমি বা মা তোমরা যেটা করবে সেটা ভাল। আমার কোনটাই কিন্তু ভাল হবে না। সেটা আমি বুঝে গেছি।”

“এই দ্যাখো তুমি কিন্তু আবার ভুল বুঝছো।”

“আচ্ছা যাক ভুল বুঝছি। বাদ দাও। আমার একটা কথার উত্তর দাওতো। আমি যদি তোমাকে জড়িয়ে ধরি, আদর করতে যাই তুমি কি সারাক্ষণ আমার সাথে দুর দুর করতে পার?”

রবি এই স্ট্রেট কথাটায় কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লো।

কারণ, সে যদি এই কথাটার ইয়েস-নো টাইপের একটা জবাব দিতে যায়, তাহলে আমাকে তার কিছুটা অপরাধি করতে হয় । ওদিকে সে চাইছে না আমি মেয়ের সামনে অপরাধী হই।

কিন্তু বিষয়টা সেরকম নয়।

আপাতদৃষ্টিতে দেখলে বিষয়টাকে খুব নিরিহটাইপ মনে হবে। কিন্তু ক্রিটিক্যালি বিষয়টা সেরকম নয়। হ্যা, সে অবশ্য, আমাকে কখনো কখনো বলেছে দ্যাখো, সন্তানতো তোমার। একটু যদি জাপটেজুপটে ধরে তাতে তোমার সমস্যা কোথায়?

সমস্যাতো একটা নিশ্চই আছ। যদি সেটা নাই থাকবে তাহলে তো আমি তাকে সেই অ্যাকসেস দিতাম। এটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। পছন্দ অপছন্দের বিষয়। আমার একটা পছন্দ অপছন্দকে আমার সন্তান সম্মান জানাবে না? বাবামায়ের একান্ত বিষয় যদি সন্তান সম্মান করতে না শেখে, সেই জীবনতো সম্পূর্ণ জীবন নয়। সেটি খন্ডিত জীবন।

সেক্ষেত্রে, মা হিসেবে সেটি বোঝানো ও মানানোটা আমার কর্ততব্য। আমি সেটাই করতে চেয়েছি। আমি সেভারেল টাইমস তাকে সে কথা বলেছিও। কিন্তু রবি তার জায়গায় অটুট থাকতে চায়। সেও চায় মালিহা আমাকে জড়িয়ে ধরুক, সেটা এমনকি আমার অপছন্দের বাইরেও। এই কারণে মেয়ের সামনে সে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লো।

এদিকে আমি দেখলাম, পরিস্থিতিটা অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। আসল বক্তব্য আড়ালে চলে যাচ্ছে।

তখন তাৎক্ষণিকভাবে উদ্ভুত বিষয়টাকে মেটানোর জন্য বললাম, “মালিহা আমি যত বড় অপরাধী হই না কেন তুমি কি আমাকে বলতে পারো আমি জঘন্য মেয়ে মানুষ? এ ধরণের কথা কি মাকে বলা যায়? তোমাকেতো আর দশটা মেয়ের মত তো ট্রিট করা হচ্ছে না। তুমি কেন টিপিক্যাল অ্যাভারেজ মানুষের মত বিহেভ করবে? তোমার তো আন্দাজও নেই তুমি কি বলেছো। যদি থাকতো, তাহলে তুমি ওই কথাটা বলতে না। …..আসলে আমারই হয়তে কোথাও ভুল আছে। পাপ আছে। তা না হলে এরকম কথা নিজের মেয়ের কাছ থেকে আমি শুনবো কেন?

বলতে বলতে আমার কথা আটকে গেল।

প্রাণপণ চেষ্টা করছিলাম শক্ত থাকতে। কিন্তু কোথ্থেকে যেন একটা আবেগ চলে এল আমি পারলাম না। আমার হাতপা অবশ হয়ে এল। একটু অভিমাণও হচ্ছিলো, ফলে তখন আর আমি কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। অস্বস্তি থেকে বাঁচতে নিজের শোবার ঘরে চলে এলাম।

রবিই বোঝাচ্ছিলো মালিহাকে।তখনও।অনেকে হয়তো আমার সমালোচনা করবেন, যেমন করেন পাশের বাড়ির ভাবি। বলেন, যাই হয় আমি রবির কানে তুলি। আরে বাবা কনে তুলবো না তো কি করবো? সমালোচনা যখন শেষপর্যন্ত আমার তাকে ইনভলবড করতে পারলাম কি পারলাম না সেটাওতো তাহলে একটা ফ্যাক্টর।তাছাড়া, একটা বিষয় আমি একটু পরিস্কার করে দিতে চাই। দেখুন, পুরুষ মানুষকে দায়িত্বশীল করে তোলাটার কাজটাকে আমি যেমন সহমর্মিতার অংশ হিসেবে দেখি, তেমনি দেখি দায়িত্বের পর্যায়ভুক্ত হিসেবেও। এ বিষয়ে ম্যক্সিম ডেভিসের একটা বই পড়েছিলাম “সেক্সুয়াল রেসপনসিবিলিটি অব উয়োম্যান” কিন্তু সেটা আমি এখন এখানে বলতে চাইছি না। রবির সেই বিষয়টা আমি পরে বলবো।

যাহোক, আমি কাঁদছিলাম আর ভাবছিলাম এখন যদি মেয়েকে নিয়ে এই হয়, সামনে কি হবে? কিভাবে সেই সব পরিস্থিতিকে আমি ম্যানেজ করবো? কোন্ ভবিতব্য অপেক্ষা করছে আমার জন্য? কোন বিপদ ধেয়ে আসছে আমার জীবনে?

অনেকক্ষণ পর, কতক্ষণ সেটা বলতে পারবো না, একসময় আমার মাথায় হাতের স্পর্শশ পেলাম। পেয়ে সচকিত হলাম।

দেখি রবি দাড়িয়ে আছে। পাশে মালিহা।

কাঁদতে কাঁদতে আমার উপর গড়িয়ে পড়লো মেয়ে। “মামনি আমি ভুল করেছি। আমার অন্যায় হয়েছে। আমি তোমার সাথে খুবই খারাপ আচরণ করেছি। আমাকে ক্ষমা কর। জানো মামনি, কি যে হয় আমার বুঝতে পারি না। রাগে অন্ধকার হয়ে যায় সবকিছু। তারপর একসময় দেখি যে, তোমাকে আমি সহ্য করতে পারছি না। প্লিজ আম্মু আমাকে ক্ষমা করে দাও।প্লিজ দাও।” তখনই আমার সন্দেহ হলো, একটা কিছু হচ্ছে যা আমি ধরতে পারছি না।

আমি মেয়েকে গভিরভাবে আঁকড়ে ধরলাম। মেয়ে হিসেবে আমি যা পারিনি মা হিসেবে আমাকে তা পারতে হবে। সাধারণ মানুষ হিসেবে আমি যা করিনি মা হিসেবে আমাকে তাই করতে হবে।

আমি সরে গেলাম নিজের জায়গা থেকে।

একজন মা-২১

পান্ডুলিপির ওপর আলোচনা-ক)

রবি বলল, তোমার গল্প নিয়ে একজন একটি মন্তব্য করেছেন।

আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিরকম?

রবি বলল খুলে।

প্রিয় পাঠক, আমি তার নামপরিচয় গোপন রাখছি, এটাই ভদ্রতা। কিন্তু যেহেতু বলেছিলাম এটা একটা ইন্টারাকশানধর্মী লেখা হবে সুতরাং এই আলোচনাটা আমি পান্ডুলিপির অন্তর্ভূক্ত করতে চাই। গবেষণাকর্মে নিযুক্ত, প্রবাসী এক ভদ্রলোক লিখেছেন-

Dear—-

I just read একজন মা- ২০. But I do not know why, I feel like, it is loosing a bit of subtlety compared to the earlier 19 sequels. To my perception, the main reason is- the dialogues in inverted commas are getting too long, descriptive and not sounding natural! Besides I was trying to recall if in a familial setting we utter such long dialogues without any interruption. Please do not take my observation so seriously! I eagerly wait for the next sequel. But this time some how it did not do the chemistry. Probably it was not the right moment for me to read this. But please carry on this wonderful peace!!! (প্রিয়—-, আমি এই মাত্র একজন মা-২০ পড়ে শেষ করলাম। কিন্ত জানিনা কেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা এর আগের ১৯ পর্বের তুলনায় সুক্ষতা হারাচ্ছে। আমি যতটুকু বুঝছি, প্রধান কারণ হলো, উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যেকার সংলাপগুলি বেশীমাত্রায় লম্বা ও বর্ণণামূলক হয়ে যাচ্ছে যাকে ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তাছাড়া, আমি মনে করতে চেষ্টা করছিলাম একটা পারিবারিক পরিবেশে আমরা ঐরকম প্রলম্বিত সংলাপ বাধাহীনভাবে বলি কিনা সেটা। দয়া করে আমার পর্যযবেক্ষণকে খুববেশী সিরিয়াসলি নেবেন না। আমি খুব আগ্রহের সাথেই পরবর্ততী পর্বের জন্য অপেক্ষা করি। কিন্তু এবার যেভাবেই হোক এটা রসটা ঠিক তৈরী করতে পারেনি। হতে পারে যে সময়টাতে আমি পড়ছিলাম সেটি আমার জন্য সঠিক ছিল না। কিন্তু প্লিজ চালিয়ে যান আপনার এই বিস্ময়কর লেখাটা)।

রবি তার উত্তরে লিখেছে Thank you for your wonderful insights. I am grateful to you. It’ll help me. Anyway, this is the structure of the story I am building. But, still I would say, your critical appreciation is highly important. There are many things missing here, subtlety is one. You are right. আপনার গভীর অন্তদৃষ্টিমূলক পর্যবেক্ষণের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আপনার পর্যবেক্ষণ আমাকে সাহায্য করবে। যাহোক, এটা হলো গল্পের কাঠামো আমি যা লিখছি। তারপরও আমি বলবো আপনার সমালোচনামূলক বৌদ্ধিকনির্যযাস ভিষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ।হ্যা অনেক কিছু মিসিং থাকছে, সুক্ষতা তার মধ্যে একটি। আপনি ঠিক বলেছেন।

তার এই উত্তর আমার পছন্দ হয়নি। আমি রবিকে যে কারণে বলেছি, দেখেছো তোমার ওপর কেন আমার রাগ হয়? তুমি সঠিককথাটা সঠিকভাবে সঠিক জায়গায় বলতে পারো না।

আমি মহান সেই পাঠকের উদ্দেশ্যে বলছি, প্রিয় মহোদয়, আমার স্বামী রবি আপনাকে ঠিকমত বিষয়টা বলতে পারেননি। এ বিষয়ে আমি একটু বলতে চাই। মেয়েসহ তাকে নিয়ে সাইকিয়াট্রিস্ট ড. লিসা ভাদুড়ির কাছে আমাদের একটা যাতায়াত আছে। এই ভদ্রমহিলা ঢাকা থেকে প্রতি বৃহস্পতিবার গরিব নেওয়াজ ক্লিনিকে আসেন।একদিনই রোগী দেখেন, পরের দিন ফাস্ট ফ্লাই্টে চলে যান। মেয়ের সাথে আমাদের সাথে সেই ডাক্তার ভদ্রমহিলার বিভিন্ন সেশনে কাউন্সিলিং হয়েছে। প্রথমবার তার সাথে কথা বলার পর থেকে মেয়েকে কোন কিছু বোঝানোর বিষয় হলে রবি লম্বা করে সংলাপ বলে। আরও একটা বিষয় জানানো দরকার, একসময় সে শিক্ষকতার কাজ করতো। তার সেই মাস্টারিভাবটা চরিত্রের মধ্যে রয়ে গেছে। এই কারণে বোঝানোর সময় হলেই তার সংলাপ দীর্ঘঘ হয়ে যায়। আর আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো বাবামায়ের থেকে এককাঠি উপরে। আমরা আর কি বোঝাবো? তারা তো প্রয়োজনের সময় আমাদেরকেই বুঝিয়ে দেয়।

একজন মা- ২২

আমি যে সরে গেলাম নিজের জায়গা থেকে এটি নতুন নয়। এর আগেও আমি এরকম করেছি। আমি যখনই বুঝতে পেরেছি আর না, আমাকে আর হেলাফেলা করলে চলবে না। আমি তক্ষুনি একটা না একটা কিছু করতে মরিহা হয়ে গেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে আর সময় নষ্ট করা উচিত হবে না।

একটা ছেলের সাথে অ্যাফেয়ার হলো, তার সাথে কথা বলে, কিন্তু মেজাজ কেন এত তার? কেন সে ভয়ঙ্কর রকম জেদি আর অনমনীয় হয়ে উঠেছে? সে আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, বোনকে সহ্য করতে পারছে না, বাবার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাচ্ছে। একি!

আমরা তার আবেগকে সম্মান জানালাম। পান্থর সাথে দিব্বি সে ফোনে কথা বলছে। হাসাহাসি করছে। রাতে শোবার আগে ফোন দিলে বাড়াবাড়িরকমভাবে ঘুমুতে দেরি করছে। সেটা ওর বাবা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আমি তাকে বোঝাচ্ছি ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু একটা মানুষের মেজাজ এমন হবে কেন?

একটা জিনিস আমার খটকা লাগলো, যতক্ষণ সে পান্থর সাথে কথা বলে হাসাহাসি করে। ততক্ষণ ঠিক থাকে। কথা শেষ অমনি কোন না কোন অছিলায় সে আমার সাথে ঝগড়া বাধাবেই।

যেদিনই আমি দেখি ও পান্থর সাথে হাসাহাসি করে, আমার বুকের মধ্যে দুরুদুরু শুরু হয়ে যায়। আজ আমার কপালে ভোগ আছে।

আমি ওর বাবাকে বলি, এই যে দেখছো না হেসে গড়িয়ে পড়ছে, একটু পর দেখবা এর ঝাল।

কেন?

আমি জানিনা কেন কিন্তু দেখবে আমার সাথে সে কি করে।

কি করবে?

দেখ তুমি। দেখতে পারলে শুনতে চায় কে?

বলতে সমস্যা কি?

আরে বাবা আমি বলছি তো একটু অপেক্ষা কর।

পান্থর সাথে কথা বলে মোবাইল চার্জে দিয়ে এলেই, আমি বললাম, এক গ্লাশ দুধ খাও। আমি চুলার উপর দুধের হাড়ি বসিয়ে দিয়েছি।

দেখুন, সিম্পল একটা বিষয়। আমি দুধ খেতে বলেছি। বলেছি কেন? তার বাড়ন্ত শরীর, তাইতো? কিন্তু মালিহা সে রাতে দুধ খাওয়ার বিষয় নিয়ে তুলকালাম বাধিয়ে দিলো। যেটা তার ভালর জন্য আমি বলেছি। সেই সিম্পল বিষয়টা নিয়ে এমন তর্কশুরু করলো যে ওর বাবা বলল, টুম্পা এটা অসুস্থতা। ওর কাউন্সিলিং দরকার।

তোমার সেই লিসা ভাদুড়ির কাছে নিয়ে যাও ওকে। খুব বেশী দেরি হওয়ার আগেই নিয়ে যাও। থিঙ্ক যে, তোমার বেবিটা নর্মাল না।

একজন মা-২৩

আপনাদের মনে থাকার কথা, মালিহা একসময় কারো বাড়িতে বেড়াতে গেলে ফেরবার সময় সেই বাড়ি থেকে ছোটখাটো জিনিসপত্র হাতে করে ফিরতো। হয়তো একটা খেলনা মটর-কার, একটা চাবির রিং বা অন্য কিছু। কাউকে কিছু না বলে আনাতো  চুরিই একপ্রকার। আমরা ওকে বোঝাতাম, মাগো, কেন এরকম কর?

দেখুন, ও যা বলতো তা অর্থহীন, আনইমপট্যান্ট। কিন্তু অস্বস্তিকর। বিষয়টা এমন পর্যায়ে চলে গেল যে অতিষ্ট হয়ে যেতে হলো। একেকটা ঘটনা ঘটে। ঘটার পর তাকে বোঝাতে শুরু করি। মজার ব্যাপর হলো, প্রথমে নিজের জায়গায় যুক্তি দিয়ে সে অটুট থাকতে চায়। কিন্তু ঐটুকু মেয়ে ওর লজিক তৈরীর ক্ষমতা কতটকু! কতক্ষণ ও আর্গুমেন্ট করবে? একসময় গিয়ে স্বিকার করে। তারপর বলে, আর করবো না।

কিন্তু কয়েকটা দিন পার হয়, তারপর আবার যা তাই। ঠিক সেই কাজটিই করে। যা খারাপ লাগে, আপনাদের সেটা বলে বোঝাতে পারবো না। একদিন আমার ছোটভাই কথাপ্রসঙ্গে আমাকে বলল, টুম্পা, একটা কাজ কর, ওকে তুই কোন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখা।

একটা কথা বলে দেওয়া যত সহজ করে ফেলা কত কঠিন তাতো জানেন। কোথায় পাবো আমি সাইকিয়াট্রিস্ট? এটা কি ঢাকা শহর? আমার ছোট ভাই বলল, তুই রবিকে নিয়ে ঢাকায় চলে আয়। আমি ব্যবস্থা করছি।

জুট মিলে ক্যাশের চাকরি রবির। চাইলেই চলে যাওয়া যায় না। ওদিকে আবার ওদের অফিসে তখন হিসাবপত্রের সবকিছু অনলাইন বেজড করার জন্য তাগিদ শুরু হয়েছে। রবি কম্পিউটার লিটারেসিতে ছিল ব-কলম, সুতরাং সে পড়ে গেছে সাংঘাতিক ঝামেলায়। ল্যাপটপ একটা কিনে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছে। সপ্তাহে সেখানে তিন দিন ক্লাশ। অফিস থেকে ফেরার পথে বয়রা গার্লসকলেজ মোড়ে নেমে ক্লাশ করে বাড়ি ফেরে। ভারি বয়সে শেখার কাজটা কেমন, জানেনতো। একাউন্টিং সফটওয়্যারের জটিলজটিল ফাংশন শিখে বাড়িতে সেটি নিয়ে প্রাক্টিস করে। কিছু জিজ্ঞাসা করলে বলে, কি বললে?

আজ যাই কাল যাই করে আমাদের ঢাকায় যাওয়া হলো না। তখন আমাদের বাড়ির পাশের এক ভাবি। ভদ্রমহিলা ফার্টিলিটি প্রবলেমে ভুগছিলেন। দুনিয়ার তাবৎ ডাক্তারকবিরাজ তার চষা। আমাকে লিসা ভাদুড়ির খবরটা দিলেন। বললেন, ঢাকা থেকে এক ভদ্রমহিলা আসেন, তিনি গরিব নেওয়াজ ক্লিনিকে বসেন, একদিনই রোগি দেখেন।

একদিনই রোগি দেখেন এই তথ্যটি ছিল ভুল। তিনি বৃহস্পতিবার আসেন, শুক্র-শনি-রবি এই তিনদিন থাকেন। সোমবার ফাস্ট ফ্লাইটে ফেরত যান ঢাকা। আমরা সিরিয়াল দিয়ে তার শরনাপন্ন হলাম।

হিন্দু মানুষ অথচ সিঁথিতে সিঁদুর নেই, হাতে শাখা নেই, এই মহিলা তাহলে অবিবাহিত। ড. লিসা ভাদুড়িকে দেখে প্রথমেই আমার বোঝা উচিত ছিল তিনি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আর একজন সাধারণ ডাক্তারের মধ্যে অনেক তফাত থাকে। আপনি সবসময় জানবেন আপনার জন্য একটা চমক অপেক্ষা করে আছে। এবং সেটা প্রথমেই।

একজন মা-২৪

অধিকাংশ পুরুষ মানুষই মেয়েদের দিকে তাকিয়ে দেখেন। সেটা বায়োলজিক্যাল। সেসব দৃষ্টির কোন কোনটা হয়ে থাকে কামনার, কোন কোনটা সৌন্দর্যয উপভোগের, কোনকোনটা স্নেহের। বয়স এখানে কোন ব্যাপার না। এদের মধ্যে কেউ কেউ পাশে স্ত্রী আছেন কিনা সেটা খেয়াল করেন না। এই যে একটা দল, রবি এই দলের।

দেখি সে আমার সামনেই পরনারীর দিকে তাকাতে বিন্দু মাত্র দ্বিধা করে না। শুনুন, আমি জীবনেও তাকে এ নিয়ে কোনদিন কিছু বলিনি। বলিনি প্রথমত: ১. ওর চাউনির দৌড় আমি জানি। আমি খুব ভাল করে পরখ করে দেখেছি দৃষ্টির মধ্যে দিয়ে ওর শরীর কখনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। ২. এটা কমপ্লিটলি বায়োলজিক্যাল। এটা ওর অভ্যাস। আমাকে বলে, এই নির্দোষ অভ্যাসকে সে স্বভাব থেকে তুলতে পারবে না।

কিন্তু যিনি দেখছেন কাউকে, সেই ব্যক্তির বোঝা উচিত তার দৃষ্টি অন্যের জন্য অস্বস্তি তৈরী করছে কিনা। এই মাত্রাজ্ঞান প্রত্যেকেরই থাকা উচিত।

রবির নেই।

আমরা রুমে ঢুকে বসেছি। রবি হা করে ড. লিসা ভাদুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোন কথা না। তিনিই শেষমেষ বললেন, আমাকে দেখতে এসেছেন নাকি কাউকে আমাকে দেখাতে এসেছেন?

বলেই ভদ্রমহিলা হাসলেন। ‘চোখ হাসে তার মুখ হাসে, সেই সাথে তার শরীর হাসে। সবকিছুর কারণে তখন মনও আমার ফাসে।’ একটা গান আছে না? ধুত মনে করতে পারছি না। কার গাওয়া তাও জানিনা। মনের মধ্যে তোলপাড় করছে কিন্তু মুখে আসছে না। যাহোক, লিসা ভাদুড়ি কে দেখে আমার এই গানটার কথা মনে পড়েছিলো। যেন ডাক্তার নন তিনি সৌন্দর্যের মডেল। তার সবকিছু মাপা, তার সবকিছু প্রোপরসনেটলি পারফেক্ট। বললেন, দেখুন, মানসিক চিকিৎসা হলো মনের জোর তৈরীর চেষ্টা, আর কিছু না। যাদের মনের জোর কম, তাদেরই সেটার প্রয়োজন। কখনো কখনো এমন হয় যে মানুষ বুঝতে পারে না তার আসলে কি করা উচিত। এই সময়টাতে তার প্রয়োজন এক্সপার্টিজ নলেজ। আমাদের মত মানুষেরা সেই কাজ করেন। এবার বলুন পরামর্শ প্রয়োজন কার?

আমি বললাম, ম্যাডাম আমার মেয়ের। (নর্মাল ডাক্তার হলে বলতো- রোগী কে?)

“আচ্ছা?”

বলেই তিনি আবার খুব সুন্দর করে হেসে একটা ভঙ্গি করলেন। সেই ভঙ্গি সাংঘাতিকরকম আন্তরিক আর তীব্রভাবে মায়াবি।“দেখুন, আমি প্রথমে সমস্যাটা শুনবো। সেটা যে কেউ বলতে পারেন। বাবা বা মা। তারপর আমি আলাদা আলাদা করে আপনাদের তিন জনের সাথে কথা বলবো। একটা কথা বলে রাখ। আমার কাছে কিছু লুকবেন না। লজ্জায় কোন বিষয় হলেও কিছু গোপন করবেন না। লুকিয়ে গেলে আমার জন্য যেমন কঠিন হবে কেসটা আপনাদের জন্য তেমনি জটিল হবে। পরে তখন আপনারাই পস্তাবেন। সুতরাং অকপটে কথা বলবেন সেটাই আমি আশা করছি। এবার আমাকে একটা কথা বলুনতো, আমি যে শাখাসিঁদুর পরি না হিন্দু হওয়া সত্বেও, এটা দেখে আপনাদের দু’জনের কার মনে হয়েছে যে, আমি অবিবাহিত?

রবি হতভম্বের মত তাকিয়ে রইল। সে কোন কিছুই বুঝতে পারছে না। তার বোঝার কথাও না। আমি বললাম, আমার।

ঠিকঠাক সম্পর্ক নির্মাণ হলো কিনা এটা হলো তার পরীক্ষা, আমি মিথ্যা বলবো কেন?

একজন মা-২৫

ড. ভাদুড়ি মেয়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আমরা কে কি করি সে সম্পর্কে একটু আগ্রহ দেখালেন। সিম্পল দু’চারটা কথা। যেমন রবি কি করে? আমি চাকরি করি কি না ইত্যাদি। তারপর সরাসরি বললেন, সমস্যাটা কি? বলেই, উনি সাথে সাথেই আবার থামিয়ে দিলেন, “একমিনিট”। বেল টিপলেন। সাথে সাথেই দরজা ঠেলে রিসেপশনের কাজে থাকা ছেলেটি ঢুকলো। ড. ভাদুড়ি মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন, মামনি, তুমি কি দ্যাখো টিভিতে? মানে তুমি ঠিক কোন চ্যানেলটা নর্মালি দ্যাখো?”

মালিহা বলল, সিএন। অর্থাৎ কার্টুন নেটওয়ার্ক।

ড. ভাদুড়ি বললেন, যব্বার ওকে টিভিতে সিএন চ্যানেলটা ধরিয়ে দাওতো। আঠারোতে আছে দেখ।

রিসেপশনের যব্বার “এসো আম্মু” বলে আমার মেয়েকে নিয়ে বাইরে গেল। ড. ভাদুড়ি আমার দিকে ফিরলেন, হ্যা। বলুন।” আমি রবির দিকে ফিরলাম। বলো।

“তুমিই বলো না”

আমি বললাম, “সমস্যা হলো, আমার মেয়ে বাইরে থেকে জিনিসপত্র চুরি করে আনে। ধরুন কারো বাসায় বেড়াতে গেছি। ফেরার সময় একটা কিছু হাতে করে ফিরলো। হয়তো একটা খেলনা মটরকার, নতুবা চাবির রিং। কিছু না কিছু একটা। ছোটখাটো জিনিস।”

“কবে থেকে এটা করে?”

“এই সম্প্রতি”

“ওর বয়স কত?”

“৮”

“আই সি”

“আর কিছু?”

“না আর কিছু না। প্রথমে যখন জিজ্ঞাসা করি। আমাকে মিথ্যা বলে। তারপর আমি যখন যুক্তি দেখাতে শুরু করি। ওকে ছেকে ধরি। ও আত্নসমর্পনকরে। স্বীকার করে। বলে, আর করবে না। কিন্তু সেটাই আবার করে।”

“ইমপাল্স কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার বলে একে। মেডিকেল সায়েন্সে এর নিক নেম ক্লেপটোমেনিয়া।

“কি লজ্জার কথা বলুনতো”

“দেখুন, লজ্জা পাওয়ার মত বিষয় হলেও ভয় পাওয়ার মত কোন ব্যাপার না।”

“কেন এমন হলো?”

“দেখুন, কেন মানুষ ক্লেপটোমেনিয়াক হয়ে ওঠে তার কারণ অজানা। তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে এর একটা জেনেটিক কম্পোনেন্ট আছে। ফার্স্ট ডিগ্রী রিলেটিভসদের থেকে এটি সংক্রামিত হতে পারে।”

“ফার্স্ট ডিগ্রী রিলেটিভস মানে?”

একজন মা-২৬

আসলে degree of relationship বলতে আমরা বোঝাই দুইটি রক্তের সম্পর্কের মধ্যে জিন শেয়ারিংএর অনুপাত।

ও আচ্ছা।

একজন ব্যক্তির ফার্স্ট ডিগ্রী রিলেটিভ হলো তার বাবা-মা, ছেলেমেয়ে।ফার্স্ট ডিগ্রী রিলেটিভ অপর জনের সাথে তাদের জিনের হাফটা শেয়ার করে। এভাবে আছে সেকেন্ড ডিগ্রী রিলেটিভ, থার্ডডিগ্রী রিলেটিভ।

বাঃ মজার বিষয়তো।

জিন বা জেনেটিক্স সাংঘাতিক এক মজার বিষয়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গুগল করে আপনি মজার মজার জিনিস জানতে পারেন। কিভাবে একটা ডিজঅর্ডার মাল্টিপুল ফ্যামিলি মেম্বরদের মধ্যে রান করে। ইত্যাদি। তবে সেক্ষেত্রে আপনার একটু ইংরেজী ভাষাজ্ঞান থাকতে হবে। আছে?

না

ও দেন আপনি লুজার। বাংলাতে এ সম্পর্কে ভাল বই ভাল বই…..আচ্ছা দেখি। আপনাকে কিভাবে সাহায্য করা যায়। যাহোক, যা বলছিলাম, একজন ব্যক্তির সেকেন্ড ডিগ্রী রিলেটিভ হলো তার চাচা, চাচী, ভাস্তে-ভাস্তি, দাদা-দাদি, পোতা-পুত্নি। এই সেকেন্ড ডিগ্রী রিলেটিভসরা ব্যক্তির সাথে তাদের তিনভাগের একভাগ জিন শেয়ার করে। থার্ডডিগ্রী রিলেটিভসরা হলো ব্যক্তির চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো ভাইবোন কিমবা গ্রেট-গ্রান্ডপ্যারেন্ট অর গ্রেট-গ্রান্ডচাইল্ড।

তাহলে আপনি বলতে চাইছেন আমার বা ওর বাবার কার না কারও এই ব্যাপারটা শিশুকালে ছিলো?

আই মিন সেটা হতে পারে। অনুপাত বিচারে সম্ভাবনা বেশী ধরা যায়।

আমি আর রবি একে অপরের মুখের দিকে তাকালাম। আর ঠিক তখন চোখ পড়লো ড. লিসার মোবাইলের ওপর। ফোনটার আলো জ্বলছে নিভছে। ভাইব্রেশন রান।

কিন্তু তিনি ধরছেন না।

একজন মা-২৭

ড. লিসা ভাদুড়ি বললেন, আপনারা দুজন একটু বাইরে যান। আমি এবার একটু আপনাদের মেয়ের সাথে কথা বলবো।  “জব্বার” বলে ডাকতেই রিসেপশনের ছেলেটা দরজা ঠেলে তার মাথাটা ভেতরে ঢুকিয়ে বলল, “জ্বি ম্যাম” তিনি বললেন, “বাচ্চাটাকে আনতো”

আমরা বাইরে বেরিয়ে গেলাম আর মালিহা ভেতরে ঢুকলো। আমরা কোন কথা বলছিলাম না। রবি দেয়ালের গায়ে লাগানো মানুষের মাথার বিভিন্ন অংশের বর্ণনা সম্বলিত পোস্টার দেখছিল। আর আমি দেখছিলাম ওকে।

পাঁচ সাত মিনিটের মাথায় সে বেরিয়েও এল। এসে বলল, বাবা তোমাকে ডাকে। রবি ভেতরে গেল। আর ঠিক তখন আমি একটা সাধারণ চিন্তায় পড়ে গেলাম। চিন্তাটা সাধারণ হলেও তার মর্মার্থ গভীর।

ডাক্তার ফাস্ট ডিগ্রী রিলেটিভসদের কথা বলেছেন, বলেছেন ইমপালস কন্ট্রোল ডিজঅর্ডার এর একটা জেনেটিক কম্পোনেন্ট থাকতে পারে। আমি নিজের কথা বলতে পারি, সারাজীবনে আমি কোন দিন এই কাজ করিনি। তাহলে, কি দাড়াচ্ছে? দাড়াচ্ছে এই যে, রবির এই স্বভাব ছিল। রবির এই স্বভাব ছিল? ছোটখাটো জিনিসপত্র চুরি করে ঘরে আনা? অসম্ভব। বিয়ের পর যে গুণটা সবচেয়ে এই মানুষটার পছন্দ করবার মত তাহল তার সততা। একটা কোমল হৃদয়।।  কোমল হৃদয়ের এই মানুষটাইতো এক সময় শিশু ছিল। যখন শিশু ছিল তখনতো তার অবস্থা আরও কোমল ছিল।  তো সেই রকম একজন কোমল হদয়ের মানুষ চুরি করে অন্যের জিনিস হাতে করে ঘরে ফিরবে? কি করে? অন্যের জিনিস হাতে করে ফিরতে হলে শক্ত কলিজা লাগে। তার কলিজা শক্ত না।

কিন্তু তার এই কথা কি ঠিক? আমার মনের মধ্যে অন্য চিন্তাও হলো। এই যে তার মেয়ে এখন এই কান্ড করছে, তার মেয়ের কলিজা কি শক্ত? অন্যের বাড়ি থেকে একএকটা ছোটখাটো জিনিস হাতে করে ফিরতে অনেক বড় কলিজা লাগছে না। দিব্বি এই কাজ সে করছে। তাহলে?

আমার সবকিছু এলমেলো হয়ে যেতে লাগলো। জট পাকিয়ে যেতে লাগলো। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে রবির স্বভাব এরকম ছিল।

একটু পর রবি বেরিয়ে এল। বলল, তুমি যাও। তোমাকে যেতে বলেছেন।

তোমাকে কি জিজ্ঞাসা করলো?

জিজ্ঞাসা করলো ছোটবেলার কথা মনে পড়ে?

আমি বললাম, পড়ে।

তারপর?

বলল, আপনি কি এরকম কখনো করেছেন? আমি বললাম না। উনি বললেন, আচ্ছা যান আপনার স্ত্রীকে আসতে বলুন।

আমি ভেতরে প্রবেশ করলাম।

ডাক্তার সাহেব বললেন, ভাল করে মনে করে দেখুনতো, আপনার ৫/৭ বছর বয়সের কথা মনে পড়ে? মনে পড়ে এরকম কখনো করেছেন কিনা?

আমি এক কথায় উত্তর দিলাম। না।

ডাক্তার সাহেব বললেন, দেখুন। ফাস্ট ডিগ্রী রিলেটিভস এর মধ্যে থেকে আসা জিনের অনেক ক্যারেক্টার সন্তানের মধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। কিন্তু পরের জেনারেশনের কারো মধ্যে সেটি দেখা যেতে পারে। যেমন মালিহার ক্ষেত্রে যে জিনটির কারণে এমনটি ঘটছে সেটি কিন্তু তার বাবারও আছে। কিন্তু দেখবেন ওর বাবা কিন্তু কোন দিন এরকম কাজে প্রবৃত্ত হয়নি। তার মানে হলো তার বাবার ক্ষেত্রে ঐ জিনটা আনএক্সপ্রেসড ছিল। অর্থাৎ ওর দাদার একটা ক্যারেক্টার ওর বাবার ক্ষেত্রে সুপ্ত থাকলেও সেটি ওর কাছে এসে ভিজিবল হচেছ। আমি কি আপনাকে বোঝাতে পেরেছি?

আমি হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম।

ড. লিসা বললেন, আপনারা কিন্তু মেয়েকে কিছু জিজ্ঞাসা করবেন না। ঠিক আছে?

আমি বললাম, ঠিক আছে।

আপনার মেয়ের বিষয়টা খুব বেশী জটিল না। সিম্পল কগনেটিভ বিহেভিহ্যারাল থেরাপিইতেই কাজ হবে। আমি জাস্ট ওকে একটা ডায়রী দেবো। আর দুই একবার সিটিং দেবো। দ্যাট উড ওয়ার্কক। ঠিক আছে?

সম্ভবত: এটি তার মুদ্রাদোষ। ড. লিসা কতক্ষণ পর পর সেন্টেন্সের শেষে এই ট্যাগকোশ্চেনটা ইউজ করছেন।

http://www.diva-portal.org/smash/get/

diva2:375135/fulltext01.pdf (women use more tags than

men do)

একজন মা-২৮

আপনাদের বরং ড. লিসা ভাদুড়ির গল্পটা বলি।

বেরিয়ে আসার আগে, ড. লিসা বললেন, এক মিনিট।

আমরা দাড়ালাম। তিনি মেয়েকে বললেন, মামনি, তোমাকে একটা ডায়রি দিলাম। এই নাও। তুমি এখানে লিখবে, কিসে তোমার রাগ হয়। কিসে তোমার আনন্দ হয়। কিসে তুমি দু:খ পাও। ঠিক আছে?

আমার মেয়ে মাথা নাড়লো। এবং সে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি বললাম, দাড়াও দাড়াও। আন্টিতো তোমার সাথে কথা বলছেন। মেয়েটা দৌড়ে বেরিয়ে গেল।

ড. লিসা বললেন, যাক। লেট হার গো। আমি শুধু এখন আপনাদেরকে একটা গল্প বলবো।

আজকের মত সেশন ক্লোজড। বলেই তিনি শুরু করলেনঃ

এক ভদ্রমহিলা একটা পাখীর দোকানে গেছেন যেখানে পোষার জন্য তারা পাখি বিক্রি করেন। সেখান থেকে তিনি একটি টিয়া পাখি কিনেছেন। কিনেছেন নিজের জন্য সখ করে, পাখিটা তাকে সঙ্গ দেবে। কথা বলবে, তার একটা ভাল সময় যাবে এই আশায়। তিনি বাড়ি ফিরে এলেন।

কিন্তু পরদিনই আবার ফেরত গেলেন দোকানদারের কাছে, “ভাই, পাখিটা তো কোন কথা বলেনি।”

দোকানদার বললেন, “ওকে আপনি কোন আয়না দেন নি? টিয়াপাখিরা আয়না খুব পছন্দ করে। তারা আয়নার মধ্যে নিজেদেরকে দেখতে চায়।”

ভদ্রমহিলা আয়না কিনে বাড়ি ফিরলেন।

কিন্তু পরেরদিনই আবার এলেন দোকানে। বললেন, “পাখিটা কথা বলছে না ভাই।”

“বাউনি দেন ‍নি, বাউনি? টিয়া পাখিরাতো  ওপরে ওঠা ও নিচে নামার কাজটা খুব পছন্দ করে।”

ভদ্রমহিলা ছোট্ট একটা বাউনি কিনে বাড়ি ফিরে এলেন।

কিন্তু পরের দিনও যথারিতি একই গল্প। “টিয়া পাখি তো কোন কথা বলছে না ভাই।”

দোকানদার বললেন, “আচ্ছা, আপনি কি ওকে একটা দোলনা দিয়েছেন? টিয়াপাখিরা কিন্তু দোল খেতে খুব পছন্দ করে। দোল খেয়ে খেয়ে তারা রিল্যাক্স করে।”

ভদ্রমহিলা দোলনা কিনে বাড়ি এলেন। যাক এবার হয়তো পাখি কথা বলবে। কিন্তু পরের দিন দোকানে গিয়ে দোকানদারকে তিনি জানালেন, টিয়াপাখিটা মারা গেছে।

দোকানদার হতভম্ব। বললেন, “আমি খুবই দু:খিত।” জিজ্ঞাসা করলেন, “একটা কথাও কি পাখিটা বলেনি মরে যাওয়ার আগে?”

ভদ্রমহিলা বললেন, “বলেছে। বলেছে, দোকানদাররা কি দোকানে কোন খাবার বিক্রি করেন না?”

ড. লিসা বললেন, “দেখুন, অনেক বাবা-মা’ই কিন্তু  গল্পের এই ভদ্রমহিলার মত। তারা চান তাদের সন্তান বেড়ে উঠুক। কিন্তু যখন দেখেন তারা, সেটা হচ্ছে না, তখন তারা সন্তানকে সবকিছু দিতে শুরু করেন। ধরে নেন সেটাই হয়তো তাদের দরকার। এইবার হয়তো তারা তাদের মনের মত হয়ে উঠবে। তারা কখনো তাকিয়ে দেখেন না তাদের সন্তানদের আসলেই কি প্রয়োজন। …ওকে। আসুন তাহলে আজ।”

ড. লিসা ভাদুড়ি হাত উচু করে আমাদের নমস্কার জানালেন। উঠে দরজা পর্র্যন্ত এলেন। আমি এই সৌজন্যবোধের কারণ ধরতে পারছিলাম না। তিনি এসেছেন তার ক্লায়েন্টকে বাই জানাতে। “মনে থাকবে তো মালিহা? কি বলেছি? তুমি লিখবে।”

“যদি লিখতে না পারি?”

“তোমার আম্মু তোমাকে সাহায্য করবে”

“আচ্ছা।”

মেয়ে দৌড় দিয়ে বেরিয়ে গেল।

লিসা ভাদুড়ি বললেন, এবার দেখবেন আপনার মেয়ে আপনার বন্ধু হয়ে উঠেছে। দেখবেন একটা ভাল বন্ডিং তৈরী হবে আপনাদের। এটাই দরকার। সন্তান হলো ঘুড়ির মত। কিন্তু লাটাই যদি আপনার হাতে থাকে। ঘুড়িকে আপনি ইচ্ছামত উড়তে দিতে পারবেন, নামাতে পারবেন।

একজন মা-২৯

আমার টিনএজ ঘুড়িটাকে আমি ইচ্ছামতই ওড়াচ্ছিলাম নামাচ্ছিলাম।

কোন সমস্যা ছিল না।

সিম্পল জিনিসপত্র চুরির যে বিষয়টা- ইমপালসিভ ডিজঅর্ডার বা ক্লেপটোমেনিয়া- সেটা ঠিক হয়ে এল।

ড. লিসা ভাদুড়ির কাছে কয়েকবার মাত্র গেলাম। ম্যাজিকের মত ফল পেলাম। একটা দারুণ রিলেশানশিপ গ্রো করলো। মজার ব্যাপার হলো, ডায়রি লিখতে গিয়ে মালিহা বাক্য সম্পূর্ণকরতে পারতো না। আমাকে জিজ্ঞাসা করতো। বানানে আটকে গেলে বানান জিজ্ঞাসা করতো। আমি বলে দিতাম। এভাবে সেও বদলে গেল, আমিও বদলে গেলাম। দু’জনেরই একটা নতুন জীবন হলো।

কিছু হলেই ড. লিসার কথা মনে পড়তো। ভদ্রমহিলা বলতেন, দেখুন, একটা স্ট্রাটেজি ফেল মারলে অন্য একটা স্ট্রাটেজিতে এগুবেন। এই যে সাজেশানটা আপনাকে দিলাম এটা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের। “একটা স্ট্রাটেজি ফেল মারতে পারে তখন আর একটা নিয়ে এগুতে হয়।” বলতেন, একটা কথা মনে রাখবেন। চুড়ান্ত নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হলে আপনাকে ভেতরে ঢুকে যেতে হবে।

বাচ্চাকাচ্চারা কিন্তু সবসময় পরীক্ষা নীরিক্ষাটাকে এনজয় করে। ধরুণ মেয়ে আপনাকে একটা রিসার্চের কথা বলল । প্রথমেই ডিজঅ্যাগ্রি করবেন না। আপনাকে সায়েন্টিস্টদের মত রোল প্লে করতে হবে। আপনি ওর হাইপোথিসিসটা শুনে প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করুন। তুখোড় সাইন্টিস্ট বনে যান। এবার সক্রেটিসের মত প্রশ্ন করে করে এগুতে থাকুন। শুধু প্রশ্ন করতে থাকুন।

ফাস্ট অ্যাগ্রিমেন্ট, দেন ক্রিটিক্যাল অ্যানালিসিস।

বলতেন, বিকাম আ সাকসেসফুল লিডার। ইয়েস। আপনাকে লিডার হতে হবে। স্ট্রাটেজিক হতে হবে। জাস্ট মনে রাখবেন, আপনি বিশ্বস্ত সায়েন্টিস্ট এর মত একটি সত্য উদ্ঘাটন করতে চাইছেন। আর কিছু না। আপনার মিশন একটাই। সত্য উদঘাটন। কাউকে ইনটেনশনালী রঙ প্রমান করা আপনার টার্গেট নয়।

আমি পেরেছিলাম।

ড. লিসা আগেই বলেছিলেন বেশী দিন লাগবে না। সত্যি তাই। বেশী দিন লাগেনি। মালিহাকে ডায়রি লেখার কাজে সাহায্য করতে করতে ওর সাথে একটা বন্ধুত্বর্পূর্ণণসম্পর্ক হয়ে গেল। কোথায় কগনিটিভ বিহ্যাভিয়ারাল থেরাপি? কিছুই লাগেনি। জাস্ট কয়েকবার নিয়ে গেছি। আর এক এক বার এক একটা মজার মজার গল্প শুনে এসেছি। একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি যে সুন্দর সুন্দর গল্প গুলি বলেন। আপনার এই বলার মধ্যে একটি গোছানো ব্যাপার থাকে। যদি কিছু মনে না করেন, আমি জানতে চাইছিলাম-

“কোথায় পাই?” বলেই হাসলেন।

আশ্চর্যক্ষমতা তার মানুষের মনের কথা বোঝার, কিছু বললেন না। পিছনের সেলফের গ্লাস সরিয়ে একটি বই এনে টেবিলের ওপর রাখলেন। বললেন, এই যে এখান থেকে।

আমি ইংরেজী না বুঝলেও পড়তে তো পারি। অবিকল বাংলাদেশের পতাকার মত লাল সবুজ পেপারব্যাপ কভার। পড়লাম: Developing the Leaders Around You/ John C Maxwell. তারপর বাকা করে লেখা How to Help Others Reach Their Full Potential

ড. লিসার কথা মত, আমি ওকে রেসপনসিবল করে তোলার জন্য ঘরের কাজে লাগিয়ে দিতাম। বিকালের নাস্তা তৈরীর সময় ওকে এটা সেটা করতে বলতাম। ও দেখতাম সানন্দে সেটা গ্রহণ করছে। রেসপনসিবিলিটাকে এনজয় করছে। আমার ভাল লাগতো। কাজের বোঝা নয় আমি ওর কাঁধে দায়িত্বের ভার চাপাতাম।

সমস্যা হয়ে গেল মালিহার সাথে পান্থর সাথে সম্পর্কের পর।

যতক্ষণ কথা বলে মোবাইলে ততক্ষণ ঠিক আছে।

কথা শেষ হলেই তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আমার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়।

Teen Girls Have Tougher Time Than Boys

ব্যাখ্যা https://www.psychologytoday.com/

blog/surviving-your-childs-adolescence/201012/the-challenge-mothering-adolescent-daughter

একজন মা-৩০

Teen Girls Have Tougher Time Than Boys

মালিহার তখন সমাপনি পরীক্ষার প্রস্তুতির সময়। এর মধ্যে ওর পিরিয়ড শুরু হয়েছে। ঠিক সেই সময় সানন্দার উপরোক্ত শিরোনামের রচনাটি আমি খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েছিলাম। বয়:সন্ধিকালে টিনেএজ ছেলেদের থেকে মেয়েদের স্ট্রেসটা একটু বেশী থাকে, কিন্তু প্রতিবেদনের কোথাও এটা লেখা ছিল না কেন।

আমি বাজারে বইয়ের সন্ধানে বের হয়েছিলাম।  সেদিন সন্তষজনক কিছু না পাওয়ায় আমার মন ও মাথার মধ্যে এই জিজ্ঞাসাটা সবসময় ছিল। আপনাদের মনে থাকার কথা।

সুতরাং একদিন ড. লিসা ভাদুড়িকে জিজ্ঞাসা করলাম, আমাকে একটু বলবেন কেন Teen Girls Have Tougher Time Than Boys ?

ড. লিসা বললেন,

“দেখুন এই বিষয়টাকে এভাবে দেখতে হবে আপনাকে। এখানে দুটি বড় ব্যাপার রয়েছে।  সোশ্যাল অ্যাটাচমেন্ট আর সেক্সুয়াল সিমিলারিটি। যত অ্যাটাচমেন্ট তত বেশি সিমিলার তত বেশী শক্তিশালি সম্পর্ক।

“মায়েরা সন্তানের সাথে বেশী অ্যাটাচড থাকেন। জন্মের আগে থেকেই তাকে সন্তান ক্যারি করতে হয়। জম্মের পর তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হয়, তাকে দেখভাল করতে হয়। সন্তানের জীবনটা শুরুই হয় মায়ের সাথে অধিকতর গভীর এক বন্ডিং দিয়ে। আর যদি সেক্সুয়াল সিমিলারিটির কথা বলেন তবে সেটা মেয়েদের থাকে মায়ের সাথে। ছেলেদের থাকে বাবার সাথে। প্রত্যেক জোড়ার থাকে সেইম সেক্সুয়াল আইডেন্টিটি।

বয়:সন্ধিকালে উঠতি বয়সি ছেলেমেয়েরা যখন নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করে, তখন এই ‘attachment versus separation’ আর ‘similarity versus differentiation’ মেয়েদেরকে অধিকতর অসুবিধাজনক অবস্থায় নিয়ে ফেলে।

আমি প্রশ্ন করলাম, “কিরকম?”

“দেখুন প্রায় সব ছেলেমেয়েরাই এই বয়সে চায় বেশী স্বাধীনতা। চায় পারিবারিক বাধাবিপত্তি ভাঙতে। তারা পরিবারের সদস্যদের চেয়ে বাইরের কারো সাথে বেশী সময় কাটাতে চায়। বেশী বেশী প্রাইভেসি চায়। বলতে গেলে, বাবা মায়ের সাথে তারা কমিউনিকেটই করতে চায় না। ছেলেমেয়েরা ঘোষণা করে এই মর্মে যে, সে এখন আর শিশু নয়।

“খেয়াল করে দেখবেন, তাদের আচার আচরণে সব সময় একটা ভারভারিক্কি ফুটে উঠতে থাকে। বার বার বলতে থাকে তারা শিশু নয়, তারা বাবা মায়ের থেকে আলাদা। ইত্যাদি। অনেক ক্ষেত্রেই তারা বাবামা যেটা চান তার উল্টো দিকে ধাবিত হতে থাকে। ঠিক এই জায়গায়  উঠতি বয়সি একটা মেয়ের কথা ভাবুন।

“প্রথমত, উঠতি বয়সের এই জটিল সময়ে একটা মেয়েকে ভাঙতে হয় ‘ডাবল কানেশন’, যেটা ছিল তার মায়ের সাথে- আই মিন ক্লোজনেস এর পয়েন্ট অব ভিউ থেকে। আর সেটা ওভারকাম করার ক্ষেত্রে মেয়েটা কিন্তু তখন ‘ডাবল ডিসকানেক্টেড’ তার বাবার সাথে। বাবা এই মুহুর্তে সেই ব্যাক্তি যার সাথে জন্মগতভাবে সে অ্যাটাচড না। আর সেক্সুয়ালী যে লোকটা বিপরিত। ওদিকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে তার মাকে যে মানুষটা জন্মগতভাবে ছিল অ্যাটাচড আবার সেক্সুয়ালী ছিল সমধর্মী।

তুলনামূলকভাবে ছেলেরা তাই পেয়ে যায় একটা সহজ প্যাসেজ। তাকে ভাঙতে হয় একটা সিঙ্গেল কানেকশন। জন্মগতভাবে সে মায়ের সাথে অ্যাটাচড হলেও তার সেক্স ছিল ভিন্ন। তাকে তখন শুধুমাত্র একটি সিঙ্গেল ডিসকানেকশনকে ওভারকাম করতে হয়। সেটা তার বাবা। যার সাথে রয়েছে তার সেক্সুয়াল সিমিলারিটি। এই কারনেই বলা হয় Teen Girls Have Tougher Time Than Boys

সেদিন ড. লিসা ভাদুড়ির সাথে সেশন শেষ করে বাড়ি ফিরছি।

আমাদের অটো বাইক নাজীরঘাট মসজিদ পর্র্যন্ত এসেছে। আসরের ওয়াক্তের সময়। নামাজের ওয়াক্তের সময় মসজিদের সামনে দিয়ে যাওয়া একটু অস্বস্তিকর। অনেক মুরুব্বি লোকের সাথে দেখা হয়ে যায়। শাড়িকাপড় ঠিক করতে হয়। মাথায় কাপড় না থাকলে দিতে হয়।

আমি মাথায় কাপড় তুলছিলাম। হঠাৎ মুয়াজ্জিন মাইকে ফু দিতে শুরু করলেন। আমি হাতের মোবাইলের সুইচ চাপলাম। আসরের ওয়াক্ত, কিন্তু আজান দেওয়ার সময়তো হয়নি। তাহলে? আমার বুকের ভেতরটা দুলে উঠলো। হায় হায় কে মারা গেল!

একজন মা-৩১

মুয়াজ্জিন বললেন, একটি শোক সংবাদ একটি শোক সংবাদ একটি শোক সংবাদ।

নাজিরঘাট নিবাসি জনাব জব্বার বড় মেয়ে মিম আজ দুপুর ২টার সময় ইনতেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহে অইন্না ইলায়হির রাজেউন। মরহুমার নামাজ-এ-জানাযা আজ বাদ ইশা তাবলিগ মসজিদের মাঠে অনুষ্ঠিত হবে।

মুয়াজ্জিন সাহেব যে কোন মৃত্যুর সংবাদ দু’বার করে পড়েন। এই সংবাদটাও দু’বার করে পড়লেন।

জব্বারটা কে? চিনলাম না। চেনার কথাও না। আমিতো এই এলাকার মেয়ে নই। আমি হলাম এই এলাকার বউ। আমার পক্ষে অনেক মানুষকে চেনা সম্ভব না।

বাড়ি গেলাম। কিছুক্ষণ পরই যে মহিলা আমাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করেন তিনি এলেন। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, রতনের মা, এই একটু আগে। একটা মৃত্যু সংবাদ পড়া হয়েছে মসজিদের মাইকে। তুমি কি চেনো মেয়েটাকে?

চিনি

কে?

জব্বার ভাইয়ের মেয়ে।

জব্বার ভাই? সেটা কে?

জিল্লাল ভাইয়ের ভাই।

জিল্লাল ভাই মানে তোমার ভাই (রবি, মালিহার বাবা) এর সাথে মাঝে মধ্যে খেলা টেলা দেখে। অনেকদিন সৌদিআরব ছিল সেই জিল্লাল ভাই?

হ্যা।

বয়স কত?

১৩/১৪ বছর।

বলকি?

হয়। আমাদের মালিহার মত। অবিকল ঐরাম দেকতি। ফর্সা। চোখদুটো কি সুন্দর। ইকবাল নগর স্কুলে পড়তো।

কি আশ্চর্য?

আশ্চর্য মানে। মানুষজন ভাঙ্গেচুরে পড়িছে ওগে বাড়ি।

কি হয়েছিল?

আপনি কিস্যু জানেন না?

না।

কিস্যু না?

না।

ওই মেয়েতো গলায় ফাঁস নিছে।

আমি হতভম্বের মত কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলাম। খাট ছিল আমার পাশে। বসে পড়লাম।

মিমের গল্পটা ভাসা ভাসা যতটুকু শুনলাম তা এইরকমঃ

মেয়েটার একটা ছেলের সাথে মন দেয়া হয়েছিল।  নাম সবুজ। তাবলিগ মসজিদের সাথে যে হাফেজিয়া মাদ্রাসা সেখানে সে হেফজো পড়ে। হেফজো পড়া মানে হলো কোরান মুখস্থ করা। কোরান মুখস্তের কাজ প্রায় শেষ। এরই মধ্যে সে বাংলা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মাঝে মধ্যে বাপের মটর সাইকেল চালায়। বাবা সেন্টারিং মিস্ত্রি। মা গৃহীণী। তারা একভাই, এক বোন। বোনটা বড়।  বিয়ে হয়ে গেছে। শশুর বাড়ি ফুলতলা। মিমের সাথে সম্পর্কনিয়ে সম্প্রতি দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। একই পাড়া। লোকজানাজানি। সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা আত্নহত্যা করেছে।

আমি গল্পে সন্তষ্ট হতে পারলাম না।

একজন মা-৩২

এক অন্যরকম আতঙ্ক আমাকে আচ্ছন্ন করে ছিল। দুধ ও ডিম দিয়ে নরম করে ফ্রাই করা ছিল পাওরুটি। বের করে ওভেনে গরম করে দিলাম। বললাম, কোন রকম ফ্যাচাং করবে না। জাস্ট দেবো খেয়ে উঠে যাবে। মালিহা তাই করলো।  কিন্তু মৃদুলা কথা শুনলো না। বলছিলো ডিমের চপ খাবে। কিন্তু মৃত্যুসংবাদ আর পরবর্তীতে তার কারণ শুনে আমার এতটাই খারাপ লাগছিলো যে, আমি কোন জাগতিক বাহানা শোনার পর্যায়ে ছিলাম না।

মৃদুলাকে ধমক দিয়ে বললাম, এক চড়ে তোমার দাত ফেলে দেবো। যেই শুনেছো ফ্রাইড পাওরুটির কথা অমনি শুরু করেছো চপের আব্দার। যেটা থাকে তার উল্টোটা খেতে চাও তুমি। এখন চপ বানিয়ে দেবো কিভাবে? জাননা চপ বানাতে গেলে টোস্ট লাগে? ঘরে টোস্ট নেই। আনাবো যে আশেপাশে কেউ নেই। খেলে খাও না খেলে যাও।

সে রাগ করে উঠে পাশের ফ্লাটে চলে গেল। সেখানে ওর বয়সি একটা মেয়ে আছে। তার সাথে খেলবে। যতক্ষণ আনবো না ততক্ষণ তার কাছেই থাকবে। কি করবো আমি? কিছুই ভাল লাগছিলো না আমার। কিন্তু আমি না পারছিলাম সে কথা কাউকে বলতে, না পারছিলাম সহ্য করতে। বার বার শুধু মরে যাওয়া মেয়েটার মায়ের কথা মনে হচ্ছিলো।

একবার মনে হলো আমি যাই। কোনদিন সে বাড়িতে যাইনি তো কি হয়েছে। আজ যাই। কোন কথা নয়, কোন আলাপ নয়, একটা মানুষ কাঁদছে তাকে একটু স্পর্শ করে আসি। কিসের সান্থনা? না কোন সান্থনা নয়। সন্তান হারিয়েছে যে মানুষটা, গতকালও মেয়েটি হেসে কথা বলেছে, কিন্তু আজ সে নেই। যে মানুষটা গতকালও মা ডাক শুনেছেন আজ তার কোল খালি। বুকের ভেতরটা বিরাণ। আমি তাকে কি সান্থনা দেবো? যত মন থেকে তাড়াতে চাই তত চিন্তাটা মাথার ভেতরে চলে আসে। একসময় আমার ভেতরে এক অন্যরকম অস্থিরতা তৈরী হলো। আমি রবিকে ফোন দিলাম।

কি কর?

কি করি মানে? অফিসে মানুষ কি করে?

রেগে যাচ্ছ কেন?

রেগে যাচ্ছি না। বল। আমার মাথা অন্য কারণে গরম হয়ে আছে।

কি কারণে?

সে আর শুনে তুমি কি করবে?

তা ঠিক। আমি শুনে কি করবো? কিন্তু সব সময় যে মানুষ সমাধানের জন্য কথা বলে তাতো নয়। কখনো কখনো মানুষতো ভার লাঘবের জন্যও কথা বলে। বলে না?

কি সমস্যা বলতো?

আমিতো শুধু সমস্যায় পড়লে তোমাকে ফোন দেই তাইনা? যাগগে, তোমার মাথা গরমের কারণ টা বল।

রবি বলল, নতুন যে একাউন্টিং সফটওয়্যারটা নিয়ে কাজ করছি সেটা গচানোর সময় ভেন্ডর বলেছিল আউট-অফ-ডেট সফটওয়্যার য়্যুজ করা আর বাসি খাবার খাওয়া একই কথা। বাসি খাবার খেলে আপনার যেমন গা গুলাতে পারে, বমি বমি ভাব হতে পারে, তেমনি আউট-অফ-ডেট সফটওয়্যারও আপনার জন্য তৈরী করতে অবিকল একই সমস্যা। ট্যাক্সের আইনকানুন, হার, ফাইনানশিয়াল বিভিন্ন প্রাক্টিস সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে বদলে যায়। এই যে সফটওয়্যারটি আপনাদের দিচ্ছি এর একটা ভাইটাল দিক হলো এটি যেমন ইউজার ট্রান্সপারেন্ট তেমনি ফাস্ট, অটোমেটিক আপডেট নেবে।

এখন সমস্যা কি?

সন্ধা থেকে বার বার ট্রই করে যাচ্ছি, এটি আপডেট নিচ্ছে না। সাবমিট অপশন কাজ করছে না।

তোমাদের আইটি ম্যানেজার কোথায়?

তার কোন এক আত্নীয় আত্ন হত্যা করেছে।  সে তাড়াতাড়ি করে ছুটে চলে গেছে দুপুর বেলা। অল্প বয়সি বাচ্চা। বয়স যা মিলিয়ে দেখলাম আমাদের মালিহার মত।

তুমি জিজ্ঞাসা করনি তাদের বাড়ি কোথায়?

সময় পাইনি।

দ্যাখো জিল্লালের ভাস্তি। জিল্লাল। তোমার বাল্য বন্ধু। অনেকদিন সৌদিআরব ছিল। মাঝেমধ্যে বাংলাদেশের খেলা পড়লে তোমার সাথে খেলা টেলা দেখে। তার ভাস্তিও আজ আত্ন হত্যা করেছে।

হোয়াট!

একজন মা-৩৩

রবি জানাযার নামাজ ধরতে পারলো না।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে এশা পার হয়ে গেল। টুকটাক কথায় কথায় একসময় জানা গেল, রবিদের আইটি ম্যানেজার বনি আমিন আমাদের পাড়াতেই এসেছিল। মিমরাই বনিদের আত্নীয়।

রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে রবির সাথে মিমের আত্নহত্যা, মালিহার অস্বাভাবিক আচরণ, পান্থর হঠাৎ করে আমাদের বাড়িতে আসাযাওয়া বেড়ে যাওয়া, রাত বিরেত ফোনে কথা বলা এসব নিয়ে কথা বলতে গিয়ে কথা শেষপর্যন্ত স্বাভাবিক রইল না।

মিমের আত্নহত্যার বিষয়ে রবি বলল, দ্যাখো, ওর বাবাকে আমি চিনি। বেচারা অহেতুক একটা মার্ডার কেস খেয়ে দীর্ঘদিন যন্ত্রণার জীবন যাপন করেছে। একজন আউলাঝাউলা মানুষ। ওর মায়ের উচিত ছিল মেয়েটার দিকে বেশী বেশী খেয়াল রাখা।

আমি বললাম, “সব শেয়ালের এক ডাক”।

উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে ছিল, রবি পাশ ফিরলো, কি বললে?

“বললাম, সব শেয়ালের এক ডাক। কিছু হয়েছে কি মায়ের এই টা উচিত ছিল। অইটা উচিত ছিল। আসলে কি জানতো । আমাদের সমাজ সংস্কৃতি আমাদের শিক্ষা, আমাদের ভ্যালুজ, এসবের মধ্যে কোথাও একটা বড় সড় ঝামেলা আছে।

“তুমি কি বলতে চাইছো?”

“আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা খুব পরিস্কার। কিছু হলে আমরা মেয়েদেরকেই প্রথমে দোষারোপ করি। এই যে মিম নামের মেয়েটা মারা গেল। তুমি জেনে হোক বুঝে হোক, শুনে হোক না শুনে হোক প্রথমে কি করলে? মাকে দায়ি করলে। হ্যা হ্যা তুমিতো সেটা করবা। কারণ তুমি তো পুরুষ মানুষ। অসহায় মানুষের উপর ঝাপিয়ে পড়ার ঐশ্বরিক অধিকার নিয়েইতো তোমরা পৃথিবীতে এসেছো।… আমিইকি বউ হয়ে এই বাড়িতে এসে কম কিছু দেখেছি ? কে কি পারে না পারে সে বিষয়ে? শাশুড়ির কাছে বউ খারাপ। ননদের কাছে ভাইবউ খারাপ, ভাইয়ের কাছে ভাবি খারাপ, একদিন চা বানালাম, তোমার বোন কি বলল? ও আমি দেখতে কালো তাই আমার চাও কালো হয়ে গেছে। মাস্টার্সফাইনাল দিচ্ছি। রাত দুটা পর্যন্ত আমাকে ঝগড়া করলেন তোমার মা। অপরাধ কি? আমি সত্য কথা বলেছি।

“এত রাতে তুমি কি ঝগড়া করবে?”

“ঝগড়া যখন করত হবে তখন আর রাত আর সকাল দেখে কি হবে?

আমার একথার উপর রবি কোন কথা বলল না, কিন্তু ঠিক এই সময় মালিহা উঠে এল ওর ঘর থেকে, “একটু আস্তে কথা বলা যায় না?”

আমি আর রবি দুজনেই অবাক।

আমাদের মেয়ে। ক্লাশ সেভেনে পড়ে। বাজে রাত সাড়ে এগারো টা। আমাদের ঘরে ঢুকে আমাদেরকে সে আস্তে কথা বলার জন্য জ্ঞান দিচ্ছে। রবি শুধু বলল, তুমি জেগে আছো কেন? কি করছো? এ ঘরের মধ্যে তুমিই বা না বলে ঢুকে পড়লে কেন?

মেয়ে কোন উত্তর না দিয়ে তার ঘরে চলে গেল। আমি বললাম, ও ফোনে কথা বলছে। পান্থর সাথে।

এত রাতে?

হ্যা ও তো মাঝে মধ্যেই আজ কাল এত রাতে ফোন করছে।

এত রাতে কি কথা?

সে ওরাই জানে।

না না না। রাতে কথা বলা যাবে না। বিশেষ করে ঘুমানোর আগে তো যাবেই না। কথা যত আছে সব রাত ৯টার আগে সেরে ফেলতে হবে। সন্ধার আগে সেরে ফেলতে পারলে সব থেকে ভাল। তুমি তো জানো না। কিন্তু এখন যদি বলি তুমি

থামলে কেন বল।

এখন যদি বলি টুম্পা তুমি খাল কেটে কুমির এনেছো। একটা টিনএজ মেয়ের সাথে তাল দিয়ে তার সম্পর্ককে অ্যালাউ করে তুমি ভুল করেছো, তুমি নারিপুরুষের চিরন্তন দ্বন্দ্বকে তুলে ধরে বলবে তোমার উপর অহেতুক দোষ চাপাচ্ছি। আল্লারে আল্লাহ। কোথাকার জল যে কোথায় গিয়ে গড়াবে শেষ পর্যন্ত!

ঘুমাও। শিখেছোতো শুধু বিলাপ করা। তোমার কথার উত্তর আমার কাছে আছে।

থাকলে বল।

বলবো না। শাক তুলতে গিয়ে কেচো তোলার কোন মানে হয় না। সকালে তোমার যেমন অফিস আছে আমারও তেমনি কাজ আছে। পাকা দুই ঘন্টার একটা ঝামেলা। দুইদুটো মেয়েকে গুছিয়ে স্কুলে নেওয়া। তোমার ব্রেকফাস্টসহ দুপুরের খাবার। দুজনেরই ঘুম দরকার। ঘুমাও।

রবি আমার গায়ে হাত দিতে গেলে আমি তার হাত সরিয়ে দিলাম।

একজন মা-৩৪

মিম নামের যে মেয়েটি মারা গেল তার প্রকৃত গল্পটি ছিল ভিষণ করুণ।

এই গল্প সেই গল্প। একদিন জিল্লাল ভাই খেলা দেখতে এলে আমি বললাম, ভাই আমাকে একটু বলুনতো ঘটনাটা কি? আত্নহত্যা করলো কেন মিম? আত্নহত্যা করার মত কি হয়েছিল?

জিল্লাল ভাই বলল, ওয়াল্লা। আপনি কিছু জানেন না?

না

আশ্চর্য! কিছু শোনেননি?

বললাম, শুনিনি বলাটা ভুল। শুনেছি। কিন্তু সন্তষ্ট হতে পারিনি। শুনেছি মেয়েটার একটা ছেলের সাথে মন দেয়া হয়েছিল।  নাম সবুজ। তাবলিগ মসজিদের সাথে যে হাফেজিয়া মাদ্রাসা সেখানে সে হেফজো পড়ে। হেফজো পড়ার কাজ প্রায় শেষ। এরই মধ্যে সে বাংলা স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মাঝে মধ্যে বাপের মটর সাইকেল চালায়। বাবা সেন্টারিং মিস্ত্রি। মা গৃহীণী।মিমের সাথে সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। একই পাড়া। লোকজানাজানি। সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা আত্নহত্যা করেছে।

ঠিকই শুনেছেন।

না ভাই। এই গল্পে অনেক কিছু মিসিং। যেমন দুই পরিবারের মধ্যে ঝগড়া কি নিয়ে? কেন ঝগড়া?

জিল্লাল ভাই বললেন, আপনার মেয়ে আছে নাকি ঘরে?

আমি বললাম, না।

দাড়ান বলতিছি।

জিল্লাল ভাই লোকটা দীর্ঘদিন সৌদিআরব থাকায় তার কথা শুরুর আগে আরবি শব্দ চলে আসে। কথা শেষও করেন আরবি শব্দ দিয়ে। যে শব্দ দুটি তিনি সবচেয়ে বেশী ব্যবহার করেন তারা হলো, ওয়াল্লা আর খালাছ। তার কথায় খুলনার আঞ্চলিক টান থাকে। কিন্তু আমার পক্ষে সব শব্দ বাক্য সঠিকভাবে তার বলার ধরণ অনুযায়ী তুলে ধরা সম্ভব হলো না।

ঐযে বলেছি, আমি লেখক না। সাধারণ একজন গৃহীনী।

জিল্লাল ভাই বললেন, ওয়াল্লা ভাবি। ভাস্তিকে সখ করে আমি একটা মোবাইল কিনে দিয়েছিলাম। দেশে যাচ্ছি একটা মোবাইল নিয়ে যাই। আমি কি জানতাম এত বড় ঘটনা ঘটে যাবে! সেই মোবাইলে কিভাবে কিভাবে যেন একদিন সবুজের সাথে পরিচয়।

কত বড় হারামি চিন্তা করেন। পরিচয় দিছে সে ফরিদপুরের এসপির ছেলে। ভাল কথা। খুব ভালকথা। মিথ্যা যখন বলবো, কম বলবো কেন? পড়ে মাদরাসায় বলিছে কলেজে। আপনি একটা জিনিস খেয়াল করবেন শয়তান ছেলেগুলি কিন্তু খুব সুন্দর করে কায়দা করে কথা বলতি জানে।

আমার ভাস্তি মিম অল্পকিছু দিনের মধ্যেই ধুন হয়ে গেল।

সারাক্ষণ তার হাতে মোবাইল। কি করে? গেম। কি করে? ফেসবুক। আমাদের বাড়িতে মনে করেন সবতো যে যার মত। কারো দিকে কারো খেয়াল নেই। কে কার খেয়াল রাখবে! সবাই আছে দৌড়ের ওপর।

সম্পর্ক বহুদুর গেল। মিথ্যা আর কতক্ষণ চলবে? একসময় প্রকৃত সত্যটা জানাজানি হয়ে গেল। কিন্তু মিম সেখান থেকে আর ফিরতে পারলো না। তার কথা হলো যারে ভালবাসিছি সে এসপির ছেলে না ডাকাতির ছেলে তা দিয়ে কি করবো? ঐ ছেলের প্রতি তার দুর্বলতা তো কমলোই না বরং বেড়ে গেল।  এদিকে ছেলের বাড়িতে জানাজানি হয়ে গেছে। সবুজদের একটাই কথা তারা আমার ভাস্তির সাথে তাদের ছেলের বিয়ে দেবেন না।

জিল্লাল ভাইয়ের কথার মধ্যে আমি জিজ্ঞাসা না করে আর পারলাম না, ভাই কিছু মনে করবেন না। মিম কোন ক্লাশে পড়ে?

ক্লাশ এইটে।

এই বয়সে বিয়ের প্রসঙ্গ এল কেন?

আমিওতো তাই বলি। এখন বিয়ের প্রসঙ্গ কেন? আর হারামির বাচ্চা তুই এই অনেক পরের কথা এখনই ওকে বললি কেন?

কথা তো তাই।

আমরা কয়েক মুহুর্ত কেউ কোন কথা বললাম না। এই সময় রবি বাথরুম থেকে বেরিয়ে হাত মুখ মুছে সোফায় গিয়ে বসলো। জিল্লাল ভাই বললেন, ভাবি এই ছেলেরে আমি বাচতে দেবো না। ও যে বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে রাস্তা দিয়ে । আপনি মনে করেন ও হলো পাকা বদ। ওর মাদরাসায় পড়া আমি বের করবো। …আসলে কি জানেন, ওর এই সম্পর্কের মধ্যে আর মন ছিল না। নিজের কথারে বাপমার কথা বলে চালায় দিছে। ভুয়া কথা বলে সম্পর্কের ফাদে ফেলে কিছু দিন আমার ভাস্তির সাথে মজা নিয়ে চম্পট। আহারে। একটা জীবন চলে গেল।

জিল্লাল ভাইয়ের শেষের দিকের কোন কথাই সেদিন আর আমার মাথায় ঢুকলো না। এদিকে বাংলাদেশের কোন খেলোয়াড় ছক্কা পিটালে রবি খুব উচ্ছাসের সাথে হাতে তালি দিতে শুরু করলে আমি রুম বেরিয়ে কিচেনের দিকে চলে গেলাম। সেখানে দাড়িয়ে জানালা দিয়ে রাস্তা দেখতে দেখতে আমি ভাবতে লাগলাম আমার নিজের মেয়েটার কথা। কি হবে আমার মেয়ের? ওর যদি ব্রেকআপ হয়ে যায়? ওই পান্থই যদি আর ওকে পছন্দ না করে?

একজন মানুষ কি অনেক পরের একটি ব্যাপার অনেক আগে থাকতে দেখে নিতে পারেন? পারেন না। মা হিসেবে আমার পক্ষে যতটুকু সতর্ক হওয়া সম্ভব আমি তাই হলাম।

মালিহাকে বললাম, মামনি আজ একটু পান্থকে আসতে বলবে। আমার কিছু কথা আছে তার সাথে।

একজন মা-৩৫

বাঙালী সেটিংএ আমাদের একটা পপুলার কালচার আছে। কালচার বলবো নাকি প্রাক্টিস বলবো বুঝতে পারছি না। কালচারটা এই রকম যে অনেক সময় জামাইকে নিজের ছেলের থেকে বেশী যত্ন করা হয়।

মায়েরা এটা কেন করেন? এটা কি কোন পরম্পরা? এর মধ্যে দিয়ে তারা কি কোন কিছু আশা করেন?

আমাদের বাড়িতে বেড়াতে গেলে রবি অনেকগুলি পদ রান্না করা দেখে আমাকে বলতো, দেখো, যদি আমিই উপলক্ষ হয়ে থাকি তাহলে এসবের দরকার নেই। আমি একটা প্রিন্সিপ্যাল আইটেমের বেশী খেতে পারিনা। বলতে পারো আমার অভ্যাস নেই। অনেকগুলি ভাইবোন  ছোটবেলা থেকে ঐভাবে মানুষ হয়েছিতো। আমি ঠিক পারি না।

কিন্তু তুমি অন্যকেতো আটকাতে পারনা তাই না? ধরো কেউ যদি তোমাকে একটু যত্ন করে আনন্দ পান?

সেই কথাটাই তো বলছি। আমি যদি উপলক্ষ হয়ে থাকি, আর সবকিছু যদি আমাকে খুশি করার জন্য হয়ে থাকে তাহলে স্টপ দিস। এটা আমাকে খুশি করে না।

পাগল আমাদের বাড়িতে সবসময়ই এমন রান্না হয়।

কথাটা জোর দিয়ে রবিকে বললেও, আসলে কি তাই? আমার মা রবি কে যত্ন করার জন্যই ঐরকম করতেন। আর রবি প্রতিবার আমাকে বলতো, প্লিজ, টুম্পা, তোমার মাকে আটকাও। আমি পারছি না। বহু মানুষ না খেয়ে থাকেন। এটা অপচয়।

একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি এমন কর কেন? আর একটা তরকারি দিয়ে খেয়ে উঠে যাও কেন?

রবি সেদিন যে গল্প বলল সেটি আবার অন্যরকম। বলল, আমার বড় বোনটারতো ফ্যামিলি রান করেনি জানতো। স্বভাবতই মেজো বোনের বিয়ে হওয়ার পর আশা করলাম যে, খুব আনন্দ করবো। খুব আনন্দ হবে আমাদের। ওমা, বিশ্বাস কর আনন্দ নয়, দুলাভাই বাড়িতে এলে আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়তাম। আমার মায়ের রান্না এত সুন্দর সেই মানুষের কোন রান্নাই তার পছন্দ হতো না। আর তা নিয়ে এত নির্দয়ভাবে তিনি অস্বস্তি প্রকাশ করতেন যে, আমার মা কাঁদতেন। তখন আমাদের অবস্থাও খুব করুণ। বাবা আমাদের অনেকগুলি ভাইবোন নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।

বলকি?

হ্যা। একদিন কি হয়েছে শোন। মা কিভাবে কিভাবে শুনেছেনদুলাভাই খাশির মাংস খুব পছন্দ করেন । জোর করে বাবাকে দিয়ে সেই মাংস আনিয়েছেন তাকে খাওয়াবেন বলে। রান্না করেছেন। তখন আমাদের বাড়িতে আলাদা ডাইনিং স্পেস নেই। ডাইনিং টেবিলটা বারান্দায় পাতা। দুলাভাই খেতে বসেছেন। সাথে তার ইমিডিয়েট ছোট ভাই। হঠাৎ দেখি সেই মাংসের বাটি উঠোনে । সাথে সাথে চারপাচপটা কাক এসে ঘীরে ধরলো সেই বাটি। আমি মায়ের সাথে কিচেনে। সেখান থেকে দেখছি। কাজটা তার ছোট ভাই নাকি তার তাৎক্ষণিকভাবে সেটি বোঝা গেল না, পরেও সেটি ধামাচাপা পড়ে গেল। কিন্তু মা যে সেই ঘটনায় কি পরিমাণ কাঁদলেন! তখন থেকে নিজের সাথে ওয়াদা আমি যদি কোন দিন জামাই হই কাউকে জ্বালাবো না। এ জাতীয় যন্ত্রণায় ফেলার তো প্রশ্নই ওঠে না।

পান্থর জন্য বিকাল বেলার নাস্তা বানাচ্ছিলাম। গরমের সময়। হঠাৎ মাথায় এল ওকে তালের কেক খাওয়াই। সাথে একটা চপ। আমি মালিহা কে জিজ্ঞাসা করলাম, মামনি তুমি কি জানো ও কি পছন্দ করে না করে?

জবাবে আমার মেয়ে বলল, মা প্লিজ তুমি কোন ঝামেলা করতে যেও না। চা/কফি বিস্কুট। ব্যস।

আমি মালিহাকে একথা জিজ্ঞাসা করেই অবাক হলাম। ভাগ্গিস আমার মেয়ে আমাকে বলেনি, সে কি তোমার জামাই? যে এত খাতির যত্ন করতে যাচ্ছো?

কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমি তালের কেক বানিয়ে নিজে খেয়ে দেখলাম তিতে লাগছে কিনা। চপ বানানোর পর নিজে চেখে দ্যাখলাম সবকিছু ব্যালান্সড আছে কিনা। আশ্চর্য। তখনই মনে হলো, রবির কথাই ঠিক। আমি যতই ননফিকশন পড়ি, আর সানন্দা পড়ি। যে পোশাকআষাকই চাপাই গায়ে।ভেতরে ভেতরে আমি টিপিক্যাল।

পান্থর উপর আমার দুর্বলতা আমি সেই প্রথম টের পেলাম।

একজন মা-৩৬

সেদিন সমস্ত ঘরবাড়ি গোছাতে গিয়ে আমার অবস্থা নাকাল। কোন একটা জিনিস সঠিক জায়গায় নেই। সমস্ত কিছু এলোমেলো। ঘরে অল্পবয়সের বাচ্চা থাকলে সেই মায়ের কতবার কতভাবে যে ঘর গোছাতে হয় তা যার গোছাতে হয় তিনিই জানেন, আর যারা জানেন না তাদের কাছে বলে লাভ নেই। সেই কষ্ট পুরোপুরি তারা বুঝবেন না। জীবনটা আমার শেষ করে দেয় ছোট মেয়ে মৃদুলা। সমস্ত খেলনা বের করবে শোকেস থেকে, পুতুল বের করবে, বিছানা করবে তাদের। কতরকম রোল যে প্লে করার আছে। কখনো সে স্কুলের আপা, কখনো সে বাড়ির কাজের লোক, কখনো সে মা।

একদিন দেখি যে গায়ে শাড়ি। ছোট্ট একটা ছেলে পুতুল কোলে। একটু পর তা আচলের নিচে। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কি করছো তুমি? মৃদুলা বলল, বাবুকে দুদু খাওয়াচ্ছি। আমি বিস্ময়ে বিমূঢ়। হাসবো নাকি কাঁদবো?

সেদিন আমি প্রতিটি জিনিসকে গুছিয়ে যার যার জায়গায় রাখলাম। গুছিয়ে মৃদুলাকে বললাম, মামনি তুমি একটু অনাবিলদের ঘরে যাও। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে চলে গেল।

অনাবিলরা আমাদের পাশের ফ্লাটেই থাকে। একই বয়সি এবং ওরা একই স্কুলে পড়ে। অনাবিলের বাবা একটা এনজিওতে চাকরি করেন আর ওর মা চাকরি করেন বাংলাদেশ ব্যাংকে। সারাদিনই দুজন বাইরে থাকেন। অনাবিলকে দেখাশোনা করেন ওদের এক খালা। ভদ্রমহিলার এত ধৈর্য, কিভাবে যে বাচ্চাটাকে ম্যানেজ করেন, তা বলার না। মৃদুলাকেও তিনি খুব সহ্য করেন। আমিতো জানি আমার মেয়ে কি পারে আর না পারে। মৃদুলার মত মেয়েকে যিনি সহ্য করতে পারেন তার ধৈর্য সম্পর্কে সার্টিফাই না করাটা অন্যায়।

মৃদুলাকে অনাবিলদের ফ্লাটে পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য হলো একটু নিরিবিলি পরিবেশ তৈরী করা। এই মেয়েটা ঘরে থাকলে পান্থর সাথে আমাকে কথাই বলতে দেবে না। সারাক্ষণ এটা সেটা। একবার গিয়ে কোলের মধ্যে বসে পড়বে। আর নানান কথার মধ্যে আটকাতে চেষ্টা করবে সে পান্থকে। যতক্ষণ পান্থ থাকবে ততক্ষণ সে মালিহার ঘরেই থাকবে।

আমি বেশ বুঝি বিষয়টা দুজনের কেউই পছন্দ করে না। কিন্তু ওদের কিছু করারও নেই। একটা বাচ্চাকে তো আর ধমক দেওয়া যায় না। এদিকে বলতেও পারছে না সহ্যও করতে পারছে না। শঙ্কাটা তৈরী হলো আমার। এরকম হতে থাকলেতো দুজনের আর ঘরে মন থাকবে না। প্রকারন্তরে সেটা আমারই জন্য বিপদ। এর মধ্যে মালিহার একদিন সে কথা বলাও হয়ে গেছে। মামনি উনি আমাকে একটু বাইরে নিয়ে যেতে চায়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছি, তুমিও কি যেতে চাও?

সে বলেছে, মাথা খারাপ?

কিন্তু আমি জানি ঘরে তার মন টিকছে না।

এর মধ্যে একদিন ড. লিসা ভাদুড়ির সাথে আমাদের নিরালা আবাসিক এলাকার মধ্যে রাস্তায় দেখা হয়েছে। একটা বাসা খুজছেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনের কিছু মেয়ে থাকে সেখানে। কথায় কথায় হাটতে হাটতে এ প্রসংগ সে প্রসংগ। আমি মেয়ের খিটখিটে মেজাজের প্রসংগ তুললে উনি একজন  সেক্স স্পেশালিস্টকে দেখাতে বললেন। বললেন, প্রাথমিকভাবে যতদুর মনে হচেছ আমার তাহলো, ওর শরীর হিট হচ্ছে কিন্তু ওতো কিছু করতে পারছে। সম্ভবও না। আপনার আমার সেক্সুয়াল কেমিস্ট্রিটা ঠিক মত রানা না করলে মনের অবস্থা কি হয়? একটা মেয়ে ফোর প্লের পর যদি অর্গাজমের আনন্দ না পায় কি হতে পারে তার? আর সেটা যদি কন্টিনিউ করে তখন?

না আমার সেক্সুয়াল স্পেশালিষ্টের কাছে যাওয়া লাগে নি। আমার মেয়ের সম্পর্কটা আর আগায় নি।

সেদিন পান্থ আসেনি। তারপর কোন দিন না।

 

অনুগ্রহ করে এই বই সম্বন্ধে আপনার মূল্যবান মন্তব্য নিচের COMMENT-এ ক্লিক করে জানান—

error: